করোনা চিকিৎসায় লামার অ্যান্টিবডি?

এখন বিশ্বের কয়েকটি দেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাভাইরাসের টিকা (ভ্যাকসিন) আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই করোনার বিপর্যয় রোধের কার্যকর উপায় পাওয়া যাবে। এরই মধ্যে আরেকটি নতুন উপায়ের সন্ধান পেয়েছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, লামার (Llama) জীবকোষ (লামা সেল) করোনার চিকিৎসায় কাজে লাগানো যায়। করোনাভাইরাস নিষ্ক্রিয় করার জন্য লামার অ্যান্টিবডি বিশেষ প্রক্রিয়ায় (রি–ইঞ্জিনিয়ারিং) মানবদেহে ব্যবহার করা যায় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

লামা আমাদের দেশে খুব পরিচিত প্রাণী নয়। এটা মূলত দক্ষিণ আমেরিকার উট প্রজাতির প্রাণী, যার পশম সংগ্রহ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। ভার বহন ও অন্যান্য কাজেও একে ব্যবহার করা যায়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, লামার শরীরে বিশেষ ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা করোনাভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে পারে। এই সূত্রই এখন বিজ্ঞানীরা কাজে লাগাতে চাইছেন।

এ বিষয়ে ইংল্যান্ডের রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের (University of Oxford the Rosalind Franklin Institute in England) গবেষকদের একটি লেখা ১৩ জুলাই নেচার স্ট্রাকচারাল মলিকুলার বায়োলজিতে (Nature Structural & Molecular Biology) প্রকাশিত হয়। গবেষকেরা দাবি করেন যে তাঁরা দুই ধরনের ন্যানোবডি তৈরি করেছেন, যা মানুষের দেহকোষে ঢুকিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা যায়। এ বিষয়ে স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের অনলাইন সংস্করণে ১৭ জুলাই বিস্তৃত লেখা বেরিয়েছে।

লামার ন্যানোবডিগুলোর রোগ প্রতিরোধপদ্ধতি মানুষের দেহের অ্যান্টিবডির মতোই। কিন্তু বাড়তি সুবিধা হলো লামার ন্যানোবডিগুলো সহজেই করোনাভাইরাসের চারপাশের আবরণের প্রোটিন চিহ্নিত করতে পারে এবং করোনার প্রোটিনকে ঢেকে ফেলে। এভাবে এই ন্যানোবডিগুলো করোনাভাইরাস নিষ্ক্রিয় করে। ন্যানোবডিগুলো এত ক্ষুদ্রকায় যে ওরা সহজেই করোনাভারাসের আবরণের ছোট ছোট ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়তে পারে, যা স্বাভাবিক আকৃতির অ্যান্টিবডি পারে না। এখানেই ন্যনোবডিগুলোর সুবিধা। লামার দেহে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ন্যানোবডি তৈরি হয় এবং ওরা সহজেই সার্স–কোভ–২ (SARS-CoV-2 virus) প্রতিহত করে।

এখন গবেষকেরা দেখছেন, রি–ইঞ্জিনিয়ারিং করে এই ন্যানোবডি মানবদেহে ঢুকিয়ে কাজে লাগানো যায় কি না। যদি এই প্রযুক্তি মানবদেহে সুফল দেয় এবং কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় না ফেলে, তাহলে এটা হবে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার।

তিন ফুট ছয় ফুট নয়, আরও বেশি
আমরা প্রথমে বলতাম, অন্তত তিন ফুট দূরে থাকলেই চলে, করোনায় সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। এরপর শুনলাম ছয় ফুটের কথা। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, আরও বেশি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের ব্যাপারটা এখনো যে আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠিনি, সেটা পরিষ্কার। আসলে সাধারণ চলাফেরায় জনে জনে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব হলেই চলে। এটা ঠিকই আছে। কিন্তু কেউ যদি ভিড়ের মধ্যে চলাফেরা করেন, তাহলে অন্তত ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। আবার দেখতে হবে, সেই ভিড়ের মধ্যে আপনি কতক্ষণ থাকছেন। যদি বেশিক্ষণ থাকেন, তাহলে আরও দূরত্ব দরকার। কারণ, প্রচুর মানুষের আনাগোনার কারণে বাতাসে ড্রপলেটগুলো অনেকক্ষণ ভেসে থাকে। হয়তো একজনের নিশ্বাসের সঙ্গে বের হওয়া ড্রপলেট তিন ফুট দূরে গিয়েই রাস্তায় পড়ে গেল, কিন্তু ততক্ষণে সেখানে আরেকজন এসে গেলেন। নতুন ড্রপলেট বের হয়ে আরও কিছু দূর গেল। এভাবে পর্যায়ক্রমে ভাসমান ড্রপলেট একটা বড় এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকবে। তাই ঝুঁকি বেশি।

আবার বাতাসের গতি বেশি থাকলে ড্রপলেটগুলো অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে থাকবে। শুধু তা–ই নয়, আপনার পাশ দিয়ে একজন সকালে শরীরচর্চার জন্য দৌড়ে যাচ্ছেন। জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছেন। এ অবস্থায় তিনি হয়তো মুখের মাস্ক একটু নামিয়ে রেখেছেন। কারণ, দৌড়–ব্যায়ামের সময় দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হয়। তাই ছুটে চলার সময় বাতাসে ড্রপলেটগুলো অনেক দূর পর্যন্ত যাবে।

তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা প্রথমে আমরা জানতে পারি মার্চ মাসের দিকে, চীন থেকে প্রবাসী শিক্ষার্থী ও অন্যান্য প্রবাসী বাংলাদেশির কাছ থেকে। তখনো দেশে করোনাভাইরাস ছড়ায়নি। চীনফেরত প্রবাসীরা বলেন, অন্তত তিন ফুট বা ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখাই যথেষ্ট, এটা চীনের ডাক্তারদেরই পরামর্শ ছিল। কিন্তু পরে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ হলো। ভাবলেন, এই ভাইরাস পুরোপুরি বায়ুবাহিত কি না, দেখা দরকার। বিশ্বের প্রায় ২৩৯ জন বিজ্ঞানী পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে বললেন, এই ভাইরাস বায়ুবাহিত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। যেমন কোথাও বেশ কয়েকজন মিলে জোর গলায় কথা বলছেন, তাহলে ড্রপলেটগুলো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। এ অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন করে বলল, ক্ষেত্রবিশেষে দূরত্ব আরও বেশি রাখতে হবে।

মাস্ক ও সাবানই ভরসা
ঈদে দূরপাল্লার বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তার মানে দেশের বিভিন্ন জেলা–উপজেলা ও গ্রামে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। অন্যদিকে সীমিতভাবে হলেও অফিস, কলকারখানা চালু রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জনসচেতনতার গুরুত্ব অনেক বেশি। বাসার বাইরে সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, যত অস্বস্তিই সইতে হোক না কেন। আর কিছুক্ষণ পরপর সাধারণ সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। বাইরে পরা জামা–কাপড় বাসায় ফিরে সাবানে কেচে নিতে হবে। বাইরে ব্যবহার করা জুতা–স্যান্ডেল বাসার বাইরে রাখা দরকার। তাহলে হয়তো আমাদের করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। এসব বিষয়ে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।

আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
[email protected]