করোনাভাইরাস টিকবে না, এটাই আশার কথা

আমরা আশাবাদী। কারণ, সামনে দেখছি উজ্জ্বল আলোর আভাস। অন্তত দুটি সম্ভাবনার জায়গা। একটি করোনার টিকা, আর অন্যটি মাস্ক। মাস্কের কথায় হয়তো অনেকেই অবাক হবেন।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমরা ফেলে আসছি একটা ভয়াবহ বছর ২০২০। করোনাভাইরাস। আর সামনে আসছে সম্ভাবনাময় একটি বছর ২০২১। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি এই সন্ধিক্ষণে। একদিকে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিস্তার, আর অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কার্যকর টিকা আবিষ্কার এবং তার সফল প্রয়োগে করোনামুক্ত বিশ্বের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। একদিকে করোনার অতিমারি, অগণিত মৃত্যু আর চাকরি হারিয়ে দারিদ্র্যহার বৃদ্ধির কালো অধ্যায়, অন্যদিকে দ্রুত টিকার প্রয়োগে ভয়হীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়।

এই অভিশপ্ত বছর ২০২০-এর শুরুতে আমরা ভাবতেও পারিনি, করোনা সারা বিশ্বে এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে কোভিড-১৯–এ সংক্রমিত হয়েছেন ৮ কোটির বেশি মানুষ। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ। আর বাংলাদেশে আক্রান্ত ৫ লাখের বেশি, মৃত্যু সাড়ে ৭ হাজার ছাড়িয়েছে। কে, কখন, কীভাবে আক্রান্ত হবেন, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অনেকেরই নেই বা থাকলেও মনে করি, কিছু হলে হোক। এ কারণে রোগটাকে সহজে বাগে আনতে পারছি না।

এই রোগ ছড়ায় শুধু করোনায় সংক্রমিত মানুষ থেকে মানুষে এবং শুধু নাক-মুখের মাধ্যমে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। হাঁচি-কাশির সময় মুখ থেকে যে বিন্দু বিন্দু পানিকণা বা ড্রপলেট ছড়ায়, সেটাই অন্যকে সংক্রমিত করে। আমরা সেটা জানলেও অনেকে পাত্তা দিই না। এ কারণে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এখন বিশ্বে চলছে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। বাংলাদেশেও তার ধাক্কা লেগেছে। নতুন বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে নাকি সংক্রমণ ও মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি। বিশেষজ্ঞরা সে রকমই ধারণা করছেন।

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্ক ও ক্যানসার, ডায়াবেটিস, কিডনি প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি। ডাক্তার-নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সামনের কাতারে কাজ করছেন—এমন ব্যক্তিদেরও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাহলে বাদ থাকছেন কে?

একটি দেশ চলতে এবং দেশের মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকতে হলে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা দরকার, সেটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায় দিনই আমরা খবর পাই, চাকরি বা উপার্জনের উপায় হারিয়ে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। সেখানেই–বা উপার্জনের সুযোগ কোথায়?

করোনার এই দুঃসময়ে দেশের নারীরা রয়েছেন সাংঘাতিক বিপদে। প্রতিদিন তাঁরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে জর্জরিত নারীদের পাশে দাঁড়াবেন কে? তা ছাড়া স্কুল-কলেজ বন্ধ। ঘরে বন্দী শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মন ভেঙে পড়ছে। তাদের সৃজনশীলতা অঙ্কুরেই ধ্বংস হচ্ছে। তাদের একটা বড় অংশ পরে হয়তো আর স্কুল-কলেজে ফিরে যেতে পারবে না। নতুন বছরে বিশ্ব হয়তো পাবে শিক্ষাবঞ্চিত কোটি কোটি শিশু-কিশোর। আগামী দিনে হয়তো মেধাসংকটে পড়বে বিশ্ব। বিশেষভাবে সমস্যাটা হবে অনুন্নত বিশ্বে। পিছিয়ে থাকা দেশগুলো আরও পিছিয়ে পড়বে।

সামনে আলোর আভাস

কিন্তু আমরা আশাবাদী। কারণ, সামনে দেখছি উজ্জ্বল আলোর আভাস। অন্তত দুটি সম্ভাবনার জায়গা। একটি করোনার টিকা, আর অন্যটি মাস্ক। মাস্কের কথায় হয়তো অনেকেই অবাক হবেন। মাস্কে তো শুধু অন্ধকার, শ্বাস গ্রহণে সমস্যা, সেখানে আবার আলোর কী চিহ্ন আছে? মাস্কের মাহাত্ম্য অনেকেই বুঝতে চাই না। সে কথায় পরে আসছি। প্রথমে আসি টিকার বিষয়ে।

মারাত্মক ধরনের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধে টিকার আবিষ্কার সাধারণত সময়সাপেক্ষ। পাঁচ থেকে ছয় বছর লাগে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে মাত্র বছরখানেকের মধ্যেই আমরা কোভিড-১৯–এর টিকা পেয়েছি। অনেক দেশে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও হয়তো মাসখানেকের মধ্যে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে। এটাই সবচেয়ে বড় সুসংবাদ। কারণ, টিকা দিলে দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। করোনার ভয় থাকবে না।

দু-তিন ধরনের টিকা আমাদের সামনে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও মডার্না এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের টিকার কথা আমরা জানি। ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষের দেহে পরীক্ষা করা হয়েছে। তেমন কোনো গুরুতর উপসর্গের কথা শোনা যায়নি। আমরা নিশ্চিত, আগামী দিনগুলো ক্রমেই ভালোর দিকে যাবে। আবার কর্মচঞ্চল পৃথিবী আমরা ফিরে পাচ্ছি।

টিকার শুরু: আরএনএ ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং

কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিজ্ঞানীদের যুদ্ধ শুরু হয় ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি, সাংহাইয়ে। সেদিন ভাইরোলজিস্ট ঝাং ইয়ংঝেন চীনের উহানে সার্সের মতো ভয়াবহ রোগ সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের (কোভিড-১৯) জিনোম অনলাইনে প্রকাশ করেন। এর ফলেই বিশ্বের বিজ্ঞানীরা নতুন করোনাভাইরাসের মূল প্রোটিন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেলেন। গবেষণা শুরু করলেন এবং টিকা আবিষ্কারের পথ খুলে গেল। এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নেচার-এ বিস্তারিত লেখা ছাপা হয়েছে (১৫ ডিসেম্বর ২০২০)।

করোনার আরএনএ ভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করে টিকা আবিষ্কার করা হয়েছে। করোনার নতুন যেসব স্ট্রেইন সৃষ্টি হচ্ছে, তারও জিনোম এখন আমরা গবেষণায় বের করছি। আমাদের দেশেও কয়েক ধরনের স্ট্রেইনের করোনার সিকোয়েন্স আমরা বের করেছি। এসব গবেষণা টিকা আবিষ্কারে সাহায্য করছে।

করোনার নতুন মিউটেশন: বর্তমান টিকায় কি কাজ হবে

যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন মিউটেশনে সবাই আতঙ্কিত। এটা বেশি দ্রুত ছড়ায়। বেশি মৃত্যুর ভয়ও অনেকে করছেন। সুতরাং টিকা যেটা আমরা পাচ্ছি, সেটা কি এই নতুন স্ট্রেইনের করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পরবে? যদি না পারে, তাহলে তো আরেক চক্করে পড়ব।

এ বিষয়ে সুখবর হলো, করোনাভাইরাসের মিউটেশন হলেও এর টিকা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সুফল দেবে। টিকা শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে, তা মিউটেশনে রূপান্তরিত ভাইরাসের বিরুদ্ধেও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। সব ভাইরাসের ক্ষেত্রে এ রকম হয় না। যেমন প্রতিনিয়ত নিউমোনিয়া ভাইরাসের মিউটেশন হয়। তাই প্রতিবছর নতুন ফ্লু শট নিতে হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সে রকম হচ্ছে না। কেন? এ বিষয়ে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিন (৯ অক্টোবর ২০২০) ও নেচার ম্যাগাজিনের নিউজ ফিচারে (৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, সংশোধিত ১৬ সেপ্টেম্বর) বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।

মূল কথাটা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাইরাসের রিসেপ্টার-বাইন্ডিং ডোমেইনের স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশন হচ্ছে না। এই স্পাইক প্রোটিনই শ্বাসতন্ত্রের কোষের (সেল) রিসেপ্টার আঁকড়ে ধরে কোষের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে বংশবিস্তার করতে থাকে। অন্যদিকে, এই স্পাইক প্রোটিনই করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে অ্যান্টিবডিকে সাহায্য করে। যেহেতু মিউটেশন হলেও করোনার স্পাইক প্রোটিন প্রায় অপরিবর্তিত থাকে, তাই বলা যায় করোনার টিকা প্রায় সব ধরনের রূপান্তরিত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। কারণ, করোনার টিকা তৈরি করা হয়েছে মূলত করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে কেন্দ্র করে। রক্তে অ্যান্টিবডি এই স্পাইক প্রোটিন দেখলেই করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে পারে এবং তাকে ধ্বংস করে। সুতরাং কোনো মিউটেশনে যদি করোনার স্পাইক প্রোটিন অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে এখন ব্যবহৃত করোনার টিকা কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

অবশ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে হয়তো করোনার স্পাইক প্রোটিনেও রূপান্তর ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো নতুন ধরনের টিকা লাগবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত খুব কম ক্ষেত্রেই এর প্রয়োজনীয়তা আছে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন।

তাই আমরা বলতে পারি, দ্রুত টিকার ব্যবস্থা করাই এখন আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের মতো দেশে ১৬ থেকে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ২ ডোজ করে প্রায় ৩৫ কোটি ডোজ টিকা আমরা কত দিনে পাব এবং সবাইকে সেই টিকা আমরা কি সুষ্ঠুভাবে দিতে পারব?

এর উত্তর হলো একটাই— মাস্ক, মাস্ক, মাস্ক। যত দিন দেশের মানুষের প্রায় ৮০ শতাংশ টিকা নিতে না পারবে, তত দিন আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা একান্ত দরকার। মোটামুটি সুরক্ষা পাওয়ার উপায় হলো সব সময় সবার মাস্ক পরে বাইরে চলাফেরা করা।

মাস্ক মাস্ট

আমাদের অনেকেই বুঝতে চাই না যে মাস্ক পরলে শুধু আমার না, চারপাশের অন্য সবাই সুরক্ষা পায়। কেন? কারণ, আমি যে দু-তিন পরত কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করি, সেটা বাইরের বাতাসে করোনাভাইরাস বহনকারী ভাসমান ড্রপলেট আমার শ্বাস গ্রহণের সময় ফুসফুসে যেতে দিতে বাধা দেয়। এটাই আমার সুরক্ষা। কিন্তু একই সঙ্গে আমি যখন জোরে কথা বলি বা জোরে হাসি, হাঁচি-কাশি দিই, তখন আমার শ্বাসতন্ত্র থেকে তীব্র বেগে ড্রপলেট বের হয়ে চারপাশে খুব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আমার মাস্ক তখন বাধা দেয় এবং আমার মুখের ড্রপলেট সামান্য দূরে গিয়েই মাটিতে পড়ে যায়। ফলে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়। কিন্তু আমার মুখে যদি মাস্ক না থাকে এবং আমি যদি করোনায় সংক্রমিত হই, তাহলে আমার চারপাশের মানুষের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই আমরা বলি, সবাই মাস্ক পরুন। কারণ, কে জানে, আমি সংক্রমিত কি না? হয়তো লক্ষণগুলো দু-এক দিন পর প্রকাশ পাবে। ইতিমধ্যে মাস্কবিহীন অবস্থায় আমি বাইরে চলাফেরা করলে অন্যদের সংক্রমিত করব। তাই সবার মাস্ক পরা একান্ত প্রয়োজন। সবাই যদি মাস্ক পরি, তাহলে টিকা নিতে দেরি হলেও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

মাস্ক পরার পাশাপাশি দিনে কয়েকবার যদি সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া ও বেশি ভিড়ের মধ্যে বেশিক্ষণ না থাকার অভ্যাস আয়ত্ত করতে পারি, তাহলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের অন্তত ৯০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা সম্ভব। অনেক বিশেষজ্ঞ এটা জানিয়েছেন।

আমরা আশা করতে পারি, করোনার দিন শেষে আসছে একুশের ভয়হীন বাংলাদেশ, বিশ্ব।


● আব্দুল কাইুয়ম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক