মহাকাশে করপোরেট প্রতিযোগিতা

মহাকাশে এখন বেশ ভিড় বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, ‘ভবিষ্যতে আমরা মহাকাশের ধ্বংসস্তূপ নিয়ে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারি

মহাকাশে এক সেন্টিমিটারের ছোট্ট একটি নুড়ির বিস্ফোরণক্ষমতা গ্রেনেডের চেয়ে বেশি। এখন সেখানে সৃষ্টি হচ্ছে লাখ লাখ টন মানবসৃষ্ট বর্জ্য। এ বর্জ্য মানুষের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে মহাকাশ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ইন্টারনেট সুবিধার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে। এসব উদ্যোগ আবার করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে। প্রশ্ন উঠছে, মানুষের জন্য মহাকাশভিত্তিক নতুন উদ্যোগ সুফল বয়ে আনবে, নাকি নতুন ঝুঁকি বাড়াবে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে।

মার্কিন সাময়িকী দ্য নিউইয়র্কারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহাকাশে সৃষ্ট বর্জ্য নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপ চলছে। মহাকাশ আবর্জনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সরকার ও বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে খুব অল্প কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক উদ্বেগ হিসেবে যুক্ত হচ্ছে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহের পুঞ্জ গড়ে তোলা।

গোটা পৃথিবীকে ইলন মাস্ক নিজের গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছেন। তবে সমালোচনা থাকলেও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নতুন উদ্যোগে ইলন মাস্কের মতো উদ্যোক্তারাই এগিয়ে আসছেন।

মার্কিন মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্সের মতো যেসব প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে কাজ করছে, তাদের দাবি, বৈশ্বিক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা বাড়াতেই তারা মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহগুচ্ছ গড়ে তুলছে।

পৃথিবীর কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ
ছবি : ওয়ান ওয়েব

যুক্তরাষ্ট্রের স্টারলিংক ও যুক্তরাজ্যের ওয়ান ওয়েব নামের দুটি প্রতিষ্ঠান একগুচ্ছ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। পৃথিবীর খুব কাছাকাছি কক্ষপথে আবর্তন করে এসব কৃত্রিম উপগ্রহ ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধা দেবে। তবে গত মাসে স্টারলিংক ও ওয়ান ওয়েবের দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ সংঘর্ষের কাছাকাছি চলে এসেছিল। দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ পরস্পরকে ২০০ ফুট দূর দিয়ে অতিক্রম করে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালে স্টারলিংকের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের আবহাওয়ার কাজে ব্যবহৃত কৃত্রিম উপগ্রহের কাছাকাছি চলে এসেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়।

স্টারলিংক মূলত যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্সের একটি উদ্যোগ। স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক। মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহের সংঘর্ষ নিয়ে সংস্থাটি বলে, তারা এ ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তাই মহাকাশে সংঘর্ষ এড়াতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রকৌশলীদের সম্ভাব্য ব্যবস্থা নিতে হয়।

মহাকাশে এখন বেশ ভিড় বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, ‘ভবিষ্যতে আমরা মহাকাশের ধ্বংসস্তূপ নিয়ে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারি। এতে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো বিপদে পড়বে। জিপিএস সেবা বন্ধ হয়ে যাবে এবং মহাকাশ ভ্রমণ ও বৈশ্বিক যোগাযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে।’

প্রকল্পের গুরুত্ব

মার্কিন সাময়িকী দ্য নিউইয়র্কারের তথ্য অনুযায়ী, স্পেসএক্সের মতো যেসব প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে কাজ করছে, তাদের প্রকল্পের গুরুত্ব বেশি। যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা নেই, সেখানকার কথা ভেবে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। কিছু পূর্বাভাসে দেখা গেছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ এখনো ইন্টারনেট সেবার বাইরে। ভূপ্রকৃতি, সংঘর্ষ, বিনিয়োগহীনতা, দারিদ্র্য ছাড়াও নানা কারণে মানুষ ইন্টারনেটের বাইরে। এসব মানুষকে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া গেলে তার প্রভাব হবে ব্যাপক।

ইলন মাস্কের তথ্য অনুযায়ী, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সবখানে কাজ করবে। এমনকি চলন্ত গাড়িতেও এই ইন্টারনেটের দুর্দান্ত গতি থাকবে। স্পেসএক্সের তথ্য অনুযায়ী, স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের বাজার এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।

বিনিয়োগকারী সংস্থা মরগ্যান স্ট্যানলির তথ্য অনুযায়ী, যদি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা দিতে কৃত্রিম উপগ্রহ গুচ্ছ সফল হয়, তবে স্পেসএক্সের মূল্যায়ন ১৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেড়ে যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, বেসরকারি সংস্থার চোখে জনসাধারণের মঙ্গলের বিষয়টি ভাবার অবকাশ না-ও থাকতে পারে। এ থেকে তারা অর্থ আয়ের দিকে বেশি মনোযোগ দেবে।

স্পেসএক্সের ব্যবসা নিয়ে সন্দেহবাদীদের সংখ্যাও বাড়ছে। কেউ কেউ সরাসরি এর সমালোচনা করছেন। সমালোচনাকারীদের অধিকাংশই অবশ্য তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান। তারাও স্পেসএক্সের মতোই মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ বসিয়ে ইন্টারনেটের ব্যবসা করতে চায়। তাদের কথা হচ্ছে, স্পেসএক্সের মতো কোম্পানি তাড়াহুড়ো করে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে।

অন্য সমালোচকেরা বলছেন, স্টারলিংকের এসব কৃত্রিম উপগ্রহের কারণে টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণে ঝুঁকি বাড়বে। কেউ কেউ বলছেন, মহাকাশভিত্তিক যোগাযোগ ব্যক্তিগত কোম্পানির হাতে যাওয়ার মানে পাবলিক কানেকটিভিটি প্রকল্পগুলো দুর্বল হবে। তাই এ ক্ষেত্রে নজরদারির প্রশ্ন আসছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন পর্যন্ত মহাকাশে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে স্পেসএক্সের মতো কোনো কোম্পানি আগ্রাসী নয়। সরকারি রকেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুবিধা নিয়ে স্পেসএক্স এখন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের মতো ‘দ্রুত চলা ও সবকিছু গুঁড়িয়ে দেওয়ার’ নীতিতে এগোচ্ছে। কিন্তু মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির সফলতার হার নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

কক্ষপথে স্টারলিংকের কৃত্রিম উপগ্রহ
ছবি : রয়টার্স

একজন শিল্প পর্যবেক্ষক ফোর্বসকে বলেন, বড় ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ গুচ্ছ উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার হারের লক্ষ্য ১ শতাংশ বা তার কম হওয়া উচিত।

কক্ষপথে কার কত উপগ্রহ

এ মুহূর্তে স্টারলিংক প্রকল্পের ১ হাজার ৩৫০ কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে রয়েছে। ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক সেবা দিতে তাদের ১২ হাজার ছোট কৃত্রিম উপগ্রহের গুচ্ছ উৎক্ষেপণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ৬ বছরে মোট ৪২ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন সংস্থাটির। এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান ওয়ানওয়েবের ১৫০টির মতো কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে রয়েছে। তাদের নেটওয়ার্ক প্রকল্পে ৬৫০টি কৃত্রিম উপগ্রহ যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই আমাজনের উদ্যোক্তা জেফ বেজোসও। তাঁর প্রকল্প কুইপারের অধীনে তিন হাজারের বেশি কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে। কানাডার প্রতিষ্ঠান টেলিস্যাট ৩০০ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করছে। রাশিয়া ও চীনের পক্ষ থেকেও তাদের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহপুঞ্জ তৈরি করার কথা। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন কর্মকর্তা ওয়াল স্টিট জার্নালকে বলেছেন, ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়ার কৃত্রিম উপগ্রহের চক্র গড়ে তোলাটা তাঁদের কৌশলগত অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে।

দরকার মান নিয়ন্ত্রণ

মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে ইন্টারনেট সুবিধার এ প্রতিযোগিতা থেকে সাধারণ মানুষ কতটাই সুফল পাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মুনাফা আগ্রাসী করপোরেট সংস্থা ও ক্ষমতার ক্ষুধার্ত দেশগুলোর কথা চিন্তা করে এ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তবে এ ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ব্যবস্থাপনার জন্য বৈশ্বিক কনসোর্টিয়াম জরুরি। এতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। মহাকাশে ভিড় আরও কমাতে এবং গ্রাহকদের জন্য ন্যায্য চুক্তি নিশ্চিতে বৈশ্বিক মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।


ভবিষ্যৎ কোন পথে?

গত বছর অক্টোবরে স্টারলিংক তাদের ইন্টারনেট সেবার পরীক্ষামূলক চালু করে। এর নাম দেওয়া হয় ‘বেটার দ্যান নাথিং বিটা’। যাঁরা পরীক্ষামূলকভাবে এ ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করেন, তাঁরা এর নেতিবাচক দিক খুব একটা পাননি। এদিকে মহাকাশ আবর্জনাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে স্পেসএক্স নিজস্ব পথ অনুসরণ করছে। তারা একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত সংঘর্ষপ্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করেছে। এ বিষয়ে খুব বেশি তথ্য জানায়নি প্রতিষ্ঠানটি। সমালোচকেরা বলছেন, সংঘর্ষ এড়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পদ্ধতি খুব বেশি কার্যকর নয়।

সমালোচকেরা বলছেন, স্বচালিত গাড়ি থেকে রকেট পরীক্ষা, এখন আবার কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে উদ্যোগ। গোটা পৃথিবীকে ইলন মাস্ক নিজের গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছেন। তবে সমালোচনা থাকলেও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নতুন উদ্যোগে ইলন মাস্কের মতো উদ্যোক্তারাই এগিয়ে আসছেন। মহাকাশে করপোরেট প্রতিযোগিতার দৌড়ে তিনি কত দূর যেতে পারেন, তা সময়ই বলে দেবে।