মেলিন্ডা ও বিল গেটসের বিচ্ছেদে চীনাদের এত আগ্রহ কেন

চীনে মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বেশ জনপ্রিয়, পশ্চিমা প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তো বটেই। গেটস দম্পতির বিচ্ছেদের খবরে চীনাদের মধ্যে তুমুল আলোচনার জন্ম দেওয়ার সেটি একটি কারণ। বাকি কারণগুলোও চলুন জানার চেষ্টা করা যাক।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে মেলিন্ডা ও বিল গেটস। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে, ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি
এএফপি

চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েইবোতে মেলিন্ডা ও বিল গেটসের বিচ্ছেদের হ্যাশট্যাগ এখন পর্যন্ত প্রায় ৯২ কোটি বার দেখা হয়েছে। আর সে হ্যাশট্যাগসহ পোস্ট করা হয়েছে ৭৩ হাজার বার। তুলনার স্বার্থে জেনে রাখা যেতে পারে, একই প্ল্যাটফর্মে ২০১৯ সালে ম্যাকেঞ্জি স্কটের সঙ্গে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের বিচ্ছেদের হ্যাশট্যাগ চীনারা দেখেছিলেন কেবল ৯ কোটি ১০ লাখ বার।

গেটসরা কীভাবে তাঁদের বিশাল সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা করবেন থেকে শুরু করে মাইক্রোসফট কিংবা তাঁদের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সম্ভাব্য পরিণতি পর্যন্ত প্রায় সব বিষয়েই আলোচনা করেছেন ওয়েইবো ব্যবহারকারীরা।

ভবিষ্যতে একে অপরের হাতে হাত না রাখলেও আশা করছি আপনাদের ফাউন্ডেশন আরও মানুষের সহযোগিতায় কাজ করে যাবে।
এক ওয়েইবো ব্যবহারকারী

দাতব্য কাজে গেটস দম্পতির অবদান

দাতব্য সংস্থাটির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচনসহ অন্যান্য উদ্যোগে তাঁরা দুজন ৫ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার ব্যয় করেছেন। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী বিল গেটসের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, আর এই সম্পদের সিংহভাগ দাতব্য কাজে ব্যয়ের কথাও জানিয়েছেন গেটস দম্পতি।

যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়
এএফপি

বিল গেটসের ওয়েইবো অ্যাকাউন্টে দেওয়া বিচ্ছেদের পোস্টে এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যাপী মানুষের জন্য আপনি এবং মেলিন্ডা অনেক অবদান রেখেছেন। ভবিষ্যতে একে অপরের হাতে হাত না রাখলেও আশা করছি আপনাদের ফাউন্ডেশন আরও মানুষের সহযোগিতায় কাজ করে যাবে।’

চীনে মাইক্রোসফটের সাফল্য

মাইক্রোসফট পরিচালনার সঙ্গে বিল গেটস এখন আর সরাসরি যুক্ত নন, তবে বেইজিংয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরিতে দশকের পর দশক কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পশ্চিমা অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান চীনে ঢোকার সুযোগ না পেলেও মাইক্রোসফটের পণ্য দেশটিতে বেশ জনপ্রিয়।

ফেসবুকের কথাই এখানে বলা যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি চীনে বন্ধ থাকলেও মাইক্রোসফটের মালিকানাধীন লিংকডইন কিন্তু দিব্যি সেখানে চলছে। আবার সার্চ ইঞ্জিন গুগলের কার্যক্রম চীনে বন্ধ, তবে মাইক্রোসফটের বিং কিন্তু বন্ধ নেই।

আমার দেখা তারকা উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিল ও মেলিন্ডা সবচেয়ে মমতাময়ী।
কাই-ফু লি

বলা যেতে পারে, চীনে মাইক্রোসফটের সাফল্যে উপকৃত হয়েছেন বিল গেটস নিজেই। ওয়েইবোতে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ৪১ লাখের বেশি। অথচ টেসলার সিইও ইলন মাস্ক এবং অ্যাপলের সিইও টিম কুককে অনুসরণ করেন যথাক্রমে ১৭ লাখ এবং ১৪ লাখ ব্যবহারকারী।

এমনকি চীনের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরাও ওয়েইবোতে গেটসদের বিচ্ছেদের আলোচনায় যুক্ত হয়েছেন। চীনে গুগলের প্রধান ছিলেন কাই-ফু লি, মাইক্রোসফট রিসার্চ ল্যাব এশিয়া প্রতিষ্ঠাতেও অবদান রেখেছেন তিনি। বিচ্ছেদের খবরটি তাঁর জন্য বিশ্বাস করা কঠিন বলে জানিয়েছেন লি। লিখেছেন, ‘আমার দেখা তারকা উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিল ও মেলিন্ডা সবচেয়ে মমতাময়ী।’

মাইক্রোসফট রিসার্চ ল্যাব এশিয়ার কথাও এখানে বলা যেতে পারে। বেইজিংভিত্তিক সংস্থাটি সে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর মেধা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সেখান থেকে উঠে এসেছেন টিকটকের মূল প্রতিষ্ঠান বাইটডান্সের প্রতিষ্ঠাতা জাং ইমিং, আলিবাবার প্রযুক্তিপ্রধান ওয়াং জিয়ান এবং সার্চ ইঞ্জিন বাইদুর সাবেক প্রেসিডেন্ট জাং ইয়াকিনদের মতো মানুষ।

২০১৩ সালে চীনের বোয়াও সম্মেলনে দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন বিল গেটস
বিল গেটসের ওয়েবসাইট গেটস নোটস থেকে

চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায়

চীনের বেইজিংয়ে ২০০৭ সালে কার্যালয় স্থাপন করে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। সে থেকে এইচআইভি নির্মূল এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে চীনা সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে সংস্থাটি।

১৯৯০ সালের পর থেকে বিল গেটস নিজেও এক ডজনের বেশিবার চীন ভ্রমণ করেছেন। সেখানের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন তিনি। চীনকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইন্টারনেটে যুক্ত করার ঠিক আগে একবার চীনে গিয়েছিলেন বিল। ১৯৯৪ সালের মার্চের সে ভ্রমণে তাঁকে স্বাগত জানান চীনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন।

সে সময় প্রযুক্তি খাতে পশ্চিমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এবং অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিল চীন। জিয়াং জেমিনকে সেবার বিল গেটস বলেছিলেন, চীনের সফটওয়্যার শিল্পের উন্নয়নে সাহায্য করবে মাইক্রোসফট। চীনা বাজারে মাইক্রোসফটের সরব উপস্থিতি নিশ্চিতের সেটা ছিল প্রথম ধাপ।

‘আপনাদেরও যদি বিচ্ছেদ হয়, তবে আমরা বাকিরা কীভাবে বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর সাহস পাব?’

২০০৬ সালে তৎকালীন চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের সৌজন্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের নিজ বাড়িতে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন গেটস।

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সাহায্যের জন্য গত বছর বিল গেটসকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছেন চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

এমনকি ক্ষমতাসীন চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টি ২০১৮ সালে বিল গেটসকে ‘চীনা জনগণের পুরোনো বন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দেয়। কোনো বিদেশির জন্য এমন পদবি ব্যবহারের নজির রাজনৈতিক দলটির ইতিহাসে বিরল।

২৭ বছর সংসারের পর গত সোমবার বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন মেলিন্ডা ও বিল। সেটার উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক চীনা বলেছেন, গেটস দম্পতির বিচ্ছেদ বিবাহ সম্পর্কে তাঁদের বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে।

ওয়েইবোতে এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘আপনাদেরও যদি বিচ্ছেদ হয়, তবে আমরা বাকিরা কীভাবে বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর সাহস পাব?’

সূত্র: সিএনএন