হকিংয়ের প্রীতিময় পরিবার

স্টিফেন হকিং ছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী। তবে বিখ্যাত হওয়ার আগে থেকেই তাঁকে আমি চিনতাম আমার মা-বাবার বন্ধু হিসেবে। আমার বাবা প্রয়াত জামাল নজরুল ইসলাম আর আমার মা সুরাইয়া অনেক সময়ই স্টিভ (স্টিফেন হকিংয়ের ডাকনাম) আর তাঁর স্ত্রী জেন ওয়াইল্ডকে কেমব্রিজের ১২ বোয়ার্স ক্রফটে আমাদের বাড়িতে নৈশভোজের আয়োজনে ডাকতেন। আমার মায়ের হাতের বাংলাদেশি রান্না তাঁরা দুজনই খুব উপভোগ করতেন। খানিকটা বড় হওয়ার পর ঘুমাতে যাওয়ার আগে মা-বাবার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নৈশভোজে মেলামেশার অনুমতি পেয়েছিলাম। এখনো মনে আছে, স্টিভ যাতে কোনো সমস্যা ছাড়াই তাঁর হুইলচেয়ারসহ আমাদের বাগানের ঢালটা পেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠতে পারেন, সে জন্য আমি আর বাবা তাঁর সঙ্গে যেতাম। স্টিভের তখনো ডিজিটাল কণ্ঠস্বরের বন্দোবস্ত হয়নি, বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ ক্রমেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠছিল। আমি তাঁর কথা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারতাম না। তবে দেখতাম, বাবা প্রায়ই স্টিভের কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠতেন। কারণ, স্টিভ ছিলেন সুরসিক আর মনোযোগী একজন মানুষ। 

আমরাও প্রায়ই স্টিভদের বাড়িতে যেতাম। কেমব্রিজের নিউহ্যাম কলেজের সড়কে ওই বাড়ির বাগানটা ছিল অপূর্ব। সুন্দর আঙিনাটা ছিল গাছে ছাওয়া। মনে পড়ে, সেখানে আমি খেলতাম। বাচ্চাদের ছুটে বেড়ানোর জন্য জায়গা ছিল দারুণ। ভালোবাসার প্রাচুর্যে তাঁদের বাড়ি ছিল উষ্ণ ও হাসিখুশিতে ভরা। মনে পড়ছে, মিড ওয়েলসের গ্রেগানগে সম্মেলনে আমরা যখন যাই, আমার বয়স তখন ৯ কি ১০ বছর। স্টিভের ছেলে রবার্ট হকিং আমার সমবয়সী। যে সুন্দর প্রাসাদোপম বাড়িটাতে সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে আমাদের জন্য চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করা হলো। আমাদের ছোটদের কাছে ব্যাপারটা ছিল মনোরম দৃশ্যপটের ভেতরে ছুটি কাটানোর মতো। পাহাড়ি ওই এলাকায় ছিল প্রচুর গাছ আর হ্রদ। রবার্ট আমাদের জন্য রাবারের একটি ডিঙি নিয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা ছিল নৈমিত্তিক পারিবারিক ছুটির দিনেরই মতো। পদার্থবিদদের সন্তানেরা জানেন, সম্মেলন বা যেখানে তাঁদের বাবা-মায়েদের পক্ষে সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে (পদার্থবিদ্যা নিয়ে!) কথা বলা সম্ভব, সেসব জায়গা ছাড়া তাঁদের সাধারণ কোনো ছুটির দিন থাকে না। 
আমার বাবা ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি তাঁকে প্রবলভাবে টানত। আমার মনে পড়ে, আমার ৬ কি ৭ বছর বয়সে বাবা যখন তাঁর কাজের মূল বিষয়গুলো আমার কাছে ব্যাখ্যা করলেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব সংকুচিত বা সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রথমবার এ কথা জানতে পেরে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। বাবার কাছে শুনেছি, স্টিভকে চিকিৎসক দুই বছরের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন, এরপরও তিনি কীভাবে বাধাগুলো জয় করেছেন। আরও জানতে পেরেছি, তিনি কতটা প্রতিভাবান আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির লোক ছিলেন। আমি জানতাম, বাবা এ কারণেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসতেন। আমি তাঁদের মহাশূন্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছি। এ কারণে আমি এই ধারণা নিয়ে বড় হয়েছি যে কেউ যদি নিজের সমস্ত মনোযোগ নিবিষ্ট করে, তাহলে যেকোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব। প্রতিবন্ধিতা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাবান মানুষটি নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করেছেন। 
জেন সুন্দর গাইতে পারতেন। তাঁদের বাড়িতে প্রায়ই গানের আসর বসত। সেখানে তিনি গাইতেন। মা-বাবার সঙ্গে তেমন আসরে প্রায়ই যাওয়ার স্মৃতি আমার আছে। আমাদের বাড়ির আসরেও বাবার অনুরোধে জেন গান করেছেন। আমার মা-বাবা সব রকম গান ভালোবাসতেন। স্টিভ বিয়ে করার আগেই আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলেও জেনের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। মা আর জেন খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন। জেন মানুষটা ছিলেন বেশ কোমল আর প্রীতিপূর্ণ, কিন্তু স্টিভের জীবনে দীর্ঘ দিন তিনিই ছিলেন শক্তির উৎস। 
বাবার কাছে পরে শুনেছি, ডিজিটাল কণ্ঠস্বর স্থাপনের পর তাতে আমেরিকান টানে উচ্চারিত নিজের কথা নিয়ে স্টিভ বেশ মজা করতেন। প্রায় পুরো বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলার পর তিনি যন্ত্রটির ব্যবহার শুরু করেন। 
স্টিভের মেয়ে লুসি হকিং আর আমি একই স্কুলে পড়তাম। কেমব্রিজের ওই স্কুলের নাম পার্স স্কুল। সে ছিল আমার কয়েক বছরের ছোট। অনেক বছর পর ওয়েলসে হে ফেস্টিভ্যালে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তত দিনে সে শিশুসাহিত্যিক হয়ে উঠেছে। বাবার সঙ্গে মিলে সে বিজ্ঞান ও বিশ্ব নিয়ে লিখছে শুনে আমি বেশ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। নতুন প্রজন্মের শিশুদের মনে সে বিজ্ঞানের বিস্ময় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল। বিজ্ঞানের উদ্দীপনা-জ্ঞানের সাধনা, কীভাবে কী হয়, আর এই পৃথিবী ও মহাবিশ্বটা কেমন-বিজ্ঞানের প্রতি এই আবেগ ও আগ্রহ বাবাই আমাদের মধ্যে সঞ্চার করেছিলেন। সে অনুভূতি বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমি লুসিকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলাম। আবার আমাদের যোগাযোগ হয়। লুসিকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানাই। সে ২০১৪ সালের নভেম্বরে ঢাকা লিট ফেস্টে যোগ দেয়। সে আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিল। মায়ের জন্য সে নিয়ে এসেছিল তার মায়ের হাতে লেখা একটি চিঠি। বাংলাদেশে এসে সে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। শিশুদের বিজ্ঞান-লেখক হওয়া সত্ত্বেও যে তাকে তারকার মতো সাদরে গ্রহণ করা হবে, সে ভাবতেও পারেনি! 
জীবনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও স্টিফেন হকিং অনেক কিছু অর্জন করেছেন এবং আমাদের ভাবার জন্য অনেক কিছু রেখে গেছেন। তাঁর অবদান আমাদের জন্য প্রকৃত উপহার আর অনুপ্রেরণা। আমার প্রত্যাশা, তাঁর অবদান বিজ্ঞানে বিনিয়োগে আমাদের অনুপ্রাণিত করবে; আমাদের শিশু-কিশোরদের বিজ্ঞানের বিস্ময়ে আগ্রহী এবং উদ্ভাবনে উৎসাহী করে তুলবে।

*সাদাফ সায কবি এবং ঢাকা লিট ফেস্টের অন্যতম পরিচালক।