নক্ষত্র স্ফুলিঙ্গ

‘স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেলো ক্ষণকালের ছন্দ!

উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল সেই ভারি আনন্দ।’

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণাগারে নক্ষত্র স্ফুলিঙ্গ বানানোর কাজ চলছে। এক বিশাল ঘরের মধ্যে রাখা হয়েছে একটি ছোট্ট ফাঁপা গোলক। গোলকটি ভর্তি করা হয়েছে ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম গ্যাসের আধাআধি মিশ্রণ দিয়ে। এরা হাইড্রোজেন পরমাণুরই অন্যরূপ। তবে ডিউটেরিয়ামের আছে একটি বাড়তি নিউট্রন, আর ট্রিটিয়ামের দুটি। পদার্থবিদেরা এই মিশ্রণকে বলেন D-T মিশ্রণ। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গোলকটি একটি সুচের আগায় বসানো। গোলকটিকে ঘিরে রেখেছে কয়েকটি শক্তিশালী লেজার বন্দুক (laser gun)। সবগুলো বন্দুকের নল তাক করে আছে গোলকটির দিকে। গোলকটির পাশে রাখা হয়েছে কয়েকটি এক্স-রে ডিটেক্টর। ঘরের দেয়ালের গায়ে বসানো আছে বেশ কয়েকটি কম্পিউটার স্ক্রিন।

কয়েকজন বিজ্ঞানী ব্যস্তভাবে হাঁটাহাঁটি করছেন, কেউ নোটবুকের পাতা ওল্টাচ্ছেন, কেউ তাকাচ্ছেন লেজার বন্দুকগুলোর দিকে, কেউবা দেয়ালের কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে। শেষবারের মতো দেখে নেওয়া হলো সব ঠিকমতো কাজ করছে কি না। সিনেমার পরিচালকের মতো একজন বিজ্ঞানী কম্পিউটারের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, অ্যাকশন, শুরু হোক নক্ষত্র বানানোর খেলা! সবগুলো লেজার বন্দুক একসঙ্গে ঝলসে উঠল। মুহূর্তেই গোলকটি হয়ে গেল এক নক্ষত্র স্ফুলিঙ্গ। নক্ষত্রের মাঝের অংশের তাপমাত্রা ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে, ওখানেই নক্ষত্র পদার্থ থেকে শক্তি বানায়। স্ফুলিঙ্গটি ক্ষণকালের জন্য নক্ষত্রের পারমাণবিক চুলায় পরিণত হলো এবং তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ, জ্বলে উঠে ফুরিয়ে গেল।

তবে নিভে যাওয়ার আগে ও বিজ্ঞানীদের একটি সাধ পূর্ণ করেছে, ও বস্তু থেকে শক্তি তৈরি করেছে। ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম পরমাণুর কিছু অংশ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে; লেজার থেকে যে পরিমাণ শক্তি জোগান দেওয়া হয়েছিল, পাওয়া গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি। বিজ্ঞানীদের এই নক্ষত্র বানানো একটি মজার খেলা। তবে বিজ্ঞানীদের আসল উদ্দেশ্য পৃথিবীর বুকে একটি ছোট্ট নক্ষত্র তৈরি করা, যা অনেক দিন বেঁচে থাকবে, আর যা থেকে মিলবে অফুরন্ত শক্তি। এই নক্ষত্র স্ফুলিঙ্গটিকে কীভাবে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখা যায়? সেই চেষ্টা চলছে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। এক্স-রে ডিটেক্টরগুলো স্ফুলিঙ্গ থেকে ছড়ানো এক্স-রের ছবি নিয়ে রেখেছে। বেশ কজন বিশেষজ্ঞ কয়েক দিন ধরে ওই এক্স-রে বর্ণালির (Spectrum) ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। স্ফুলিঙ্গের তাপমাত্রা, ঘনত্ব, উত্তেজিত পরমাণুগুলোর হালচাল—সব খবরই মিলবে ওই বর্ণালি থেকে। সেই সঙ্গে মিলতে পারে চিরস্থায়ী খুদে নক্ষত্র বানানোর কিছু অজানা তথ্য।

সূর্য একটি নক্ষত্র। এই পৃথিবীর সব কয়লা, পেট্রোল, জঙ্গল, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে যে শক্তি জুটবে সূর্য এক সেকেন্ডে বানায় তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি শক্তি। সূর্য কেমন করে এ কাজটি করে? ১৯০৫ সালের আগে বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে অনেক ভেবেছেন, কোনো কূলকিনারা মেলেনি। সেকালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখকেরা এ নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য গল্প। ১৮৭০ সালের দিকে ফরাসি লেখক জুল ভার্ন লিখেছিলেন টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি এবং মিস্ট্রিয়াস আইল্যান্ড নামের দুটি বই, যা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। বেশ কয়েকটি সিনেমা হয়েছে এই বই দুটি নিয়ে, হয়েছে অনেক টিভি সিরিজ। নিজের হাতের গড়া সাবমেরিন নটিলাস নিয়ে সমুদ্রের তলে তাঁর দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এই গল্পের নায়ক ক্যাপ্টেন নিমো। তিনি ভারতের এক বিদ্রোহী রাজকুমার। ১৮৫৭ সালের ভারতের ব্রিটিশবিরোধী প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামে (সিপাহি বিদ্রোহ) এই রাজকুমার হারিয়েছেন তাঁর মা-বাবাকে। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছেন তিনি। মহাবিজ্ঞানী ক্যাপ্টেন নিমো তাঁর সাবমেরিন নিয়ে একাই লড়াই করে চলেছেন ব্রিটিশ রণতরির বিরুদ্ধে, ডুবিয়ে দিচ্ছেন একের পর এক সমুদ্রজাহাজ। সাবমেরিনটির শক্তির উত্স কী তা নিয়ে বিজ্ঞান-উত্সাহী পড়ুয়াদের জল্পনাকল্পনার শেষ ছিল না। সূর্যের শক্তি বানানোর গোপন রহস্য কি নিমো জানতেন?

১৯৫৪ সালে নির্মিত আমেরিকার পারমাণবিক শক্তি পরিচালিত সাবমেরিন ইউএসএ নটিলাস ৫৭১-এর নামকরণ হয়েছে ক্যাপ্টেন নিমোর সম্মানে। তবে বলে রাখা ভালো, এ যুগের পারমাণবিক সাবমেরিন সূর্যের পদ্ধতিতে শক্তি তৈরি করে না। সূর্য দুটো হালকা পরমাণুকে জোড়া দেয়, কিন্তু সাবমেরিনের পারমাণবিক চুলা একটা ভারী পরমাণুকে ভেঙে ফেলে। বিজ্ঞানীদের ভাষায় এই পদ্ধতিগুলো যথাক্রমে নিউক্লিয়ার ফিউশন আর নিউক্লিয়ার ফিশন নামে পরিচিত।

১৯৫৪ সালের ডিজনি সিনেমায় নিমোকে ইউরোপিয়ান হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই গল্পে নিমোর যুদ্ধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নয় বরং ‘সভ্য’ মানুষের বিরুদ্ধে। নিমোর গোপন বিজ্ঞান গবেষণার খবর জানার জন্য যারা নিমোর স্ত্রী-সন্তানদের নির্যাতন করে খুন করেছে। এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে পুড়ে যায় গোপন দ্বীপে নিমোর আস্তানা, সেই সঙ্গে পৃথিবীর বুকে সূর্য বানানোর স্বপ্ন। এখন বিজ্ঞানীরা আদাজল খেয়ে লেগেছেন নিমোর স্বপ্ন সফল করতে।

সূর্য কেমন করে এত শক্তি তৈরি করে সেই গোপন কথাটা আইনস্টাইন প্রথম ফাঁস করেন। ১৯০৫ সালে তিনি প্রকাশ করলেন আপেক্ষিক তত্ত্ব। অপূর্ব এই তত্ত্বের ঝুড়ি থেকে বের হলো আজব সব খবর: চলন্ত পথিকের হাতের ঘড়ি আস্তে ঘোরে, তার পকেটের গজকাঠি ছোট হয়ে যায়, তার ভরবেগ যায় বেড়ে ইত্যাদি। আরেকটি মজার কথা জানা গেল যে বস্তু শক্তির এক বিশেষ রূপ, বস্তু থেকে শক্তি বানানো যাবে এবং শক্তি থেকে বস্তু। সূর্য বস্তু থেকে শক্তি বানায়। এই বস্তু-শক্তি রূপান্তরের সমীকরণটি এখন অনেকেরই জানা, E=mc2। এখানে E হলো এনার্জি বা শক্তি, c হলো আলোর গতিবেগ, m হলো বস্তুর ভর। আলোর গতি বেজায় বড় একটি সংখ্যা, ওকে বর্গ করলে ও যাবে আরও অনেক বেড়ে। তাই খুব অল্প পরিমাণ পদার্থ থেকে অঢেল শক্তি জোটে। কিন্তু এই রূপান্তর ঘটাতে কী করতে হবে? এসব ছোটখাটো ব্যাপারে আইনস্টাইন সাধারণত নাক গলাননি। তিনি এক রত্নভান্ডারের খবর এনে দিলেন, ওখানে কী সব রত্ন লুকিয়ে আছে তার খোঁজ করার ভার পড়ল অন্যদের ওপর। ইতালির বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি সেই যে সুইডেনে গেলেন নোবেল পুরস্কার নিতে, দেশে আর ফিরলেন না, চলে এলেন আমেরিকায়। ১৯৪২ সালে ফার্মি ভারী ইউরেনিয়াম অ্যাটমকে নিউট্রন দিয়ে গুঁতা মেরে বানালেন পদার্থ থেকে শক্তি। এটাই প্রথম নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিশন রিঅ্যাকশন। এই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর শিকাগো পাইল-১ নামে পরিচিত। সূর্যের মতো দুটি হালকা পরমাণুকে জোড়া দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি তৈরি এখনো সম্ভব হয়নি। পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন, হরেক উপায়ে চেষ্টা চলছে। এই শক্তিস্বর্গ খুব বেশি দূরে নয়।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত