এসএসসির ফরম পূরণের টাকা জোগাতে ম্যারাথনে দৌড়েছিলেন আলামিন
মো. আলামিনের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। ছেলেবেলা থেকেই মেঠোপথ দিয়ে ছুটতেন এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। মায়ের বকুনি থামাতে পারত না তাঁকে। রিকশাচালক বাবা চাইতেন, ছেলে ছোটবেলা থেকেই কাজে লেগে পড়ুক। কিন্তু মায়ের ইচ্ছায় আলামিনের পড়ালেখা চলে। পড়ালেখার জন্যই দিনাজপুরে মামার বাড়িতে কেটেছে শৈশবের অনেকটা সময়। নানা বাধা পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে আলামিন পৌঁছেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসে দৌড়বিদ হিসেবে তাঁর সুনাম আছে। থাকবে না-ই বা কেন! জাতীয় পর্যায়ের একাধিক ম্যারাথনে অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছেন এই তরুণ।
পুরস্কারের টাকায় এসএসসির ফরম পূরণ
গ্রামে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে আয়োজিত দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন মো. আলামিন। অন্য প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতেন লম্বা ব্যবধানে। পরে স্কুলশিক্ষকদের সহযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন। ৪০০ ও ৮০০ মিটার দৌড়ে সাফল্যও পেয়েছিলেন। অভাবের সংসারে এ অর্জন পাত্তা পায়নি। টাকার জন্য কিছুদিন রাজমিস্ত্রির কাজও করেছেন তিনি। বাবা সব সময় বলতেন, ‘লেখাপড়া বাদ দিয়ে কাজে নামো।’ বড় বিপত্তি আসে এসএসসি পরীক্ষার সময়। কারণ ফরম পূরণের তিন হাজার টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের ছিল না।
এমন সময় আলামিনের চোখে পড়ে একটা পোস্টার। দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত হবে ২১ কিলোমিটার ম্যারাথন। প্রাইজমানিও বেশ ভালো। কিন্তু এত লম্বা দৌড়ে তো আগে কখনো অংশ নেননি। পারবেন? ওদিকে টাকার ব্যবস্থা না হলে এসএসসি পরীক্ষাও দেওয়া হবে না। কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই অনুশীলন শুরু করেন তিনি। চলে একটানা ২০ দিন। আলামিন বলেন, ‘সময়টা অনেক কঠিন ছিল। ম্যারাথনে অংশ নেওয়ার মতো জুতাও আমার ছিল না। প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরে দৌড়েছি। সেই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়ে সাত হাজার টাকা পাই। সেটা দিয়ে এসএসসির ফরম পূরণ করি।’
যে দৌড়ের ফিনিশ লাইন নেই
স্কুলজীবন থেকেই টিউশনি করতেন। কলেজের পড়াশোনার খরচ চালানোর একমাত্র সম্বলও ছিল ওই টিউশনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেও টিউশনি করেছেন। পাশাপাশি দৌড়ের চর্চা তো ছিলই। পড়ার বিষয় যেহেতু শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান, এবার আর সমস্যা হয়নি। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় ৫ হাজার ও ১০ হাজার মিটারের দৌড়ে শিরোপাও জিতেছেন। কিন্তু করোনার হানায় আবার পড়লেন বিপাকে।
মা–বাবা বলতে থাকেন, ‘বসে বসে তো খাওয়া যায় না, একটা কিছু কর।’ অতএব নিজ গ্রামেই অনুশীলন শুরু করেন আলামিন। তিন-চার মাস অনুশীলনের পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অংশ নেন সিলেট হাফ ম্যারাথনে। সবাইকে অবাক করে জিতে যান শিরোপা। এরপর বাদ দেন সব টিউশনি। করোনার সময় হল বন্ধ থাকায় মেস ভাড়া নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই। অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন তিনি।
তিন-চার মাস অনুশীলনের পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অংশ নেন সিলেট হাফ ম্যারাথনে। সবাইকে অবাক করে জিতে যান শিরোপা। এরপর বাদ দেন সব টিউশনি। করোনার সময় হল বন্ধ থাকায় মেস ভাড়া নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই। অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন তিনি।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় আয়োজিত ১০টি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ১০টিতেই শিরোপা জিতেছেন আলামিন। ভালো অঙ্কের টাকাও পেয়েছেন, তা দিয়েই নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেন। মুঠোফোনে আমাদের বলেন, ‘আসলে সে রকম সুযোগ-সুবিধা তো কখনো পাইনি। অ্যাথলেটদের নিয়ন্ত্রিত জীবন সম্পর্কেও তেমন ধারণা ছিল না। নিজের মতো করে চেষ্টা করতাম। ১০টা ম্যারাথনে জয় পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়েও স্যারদের চোখে পড়েছিলাম। উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন স্যারসহ সবাই পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন আমার বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জাফিরুল স্যার। আর্থিকভাবে সাহায্য করার পাশাপাশি খোঁজ রেখেছেন সব সময়। স্যারের পরামর্শ আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’
অনুপ্রেরণা পেয়ে শুরু হয় নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াই। জাতীয় পর্যায়ে ১০ কিলোমিটার দৌড়ে সারা দেশের বাঘা বাঘা খেলোয়াড়ের সঙ্গে লড়ে পঞ্চম হন তিনি। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকা ম্যারাথনে ২১ কিলোমিটার দৌড়ে হয়েছেন তৃতীয়। প্রথম তিনজনের মধ্যে আলামিনই একমাত্র বেসামরিক দৌড়বিদ।
দেশসেরা খেলোয়াড় হয়ে এই তরুণ ছুটতে চান অলিম্পিকের মঞ্চে। বলেন, ‘স্বপ্ন তো অনেক। দেখা যাক কত দূর যেতে পারি। প্রথম লক্ষ্য হলো, মা-বাবাকে ভালো রাখতে চাই। আর ব্যক্তিগত লক্ষ্য ম্যারাথনে দেশসেরা হওয়া৷ আমি অনুসরণ করি অলিম্পিকজয়ী ব্রিটিশ অ্যাথলেট মো. ফারাহকে৷ হয়তো আমিও একদিন তাঁর মতো হয়ে আমার দেশকে গর্বিত করতে পারব।’