আগের পর্বেই জেনেছ যে রামানুজন মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের অধীনে একটি সামান্য পদের চাকরিতে যোগদান করেন। তো পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করার সময় কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা রামানুজনের নোটবুক নিয়ে বেশ উৎসাহ প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে গণিতের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। ১৯১১ সালে তাঁর প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ ‘জার্নাল অব দ্য ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সংখ্যাতত্ত্বের ওপর গবেষণালব্ধ Some Properties of Bernoulli’s Numbers নামক তাঁর প্রথম দীর্ঘ প্রবন্ধ একই বছর প্রকাশিত হয়।
১৯১২ সালে একই পত্রিকায় তাঁর আরও দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং সমাধানের জন্য কিছু প্রশ্নও প্রকাশিত হয়। রামচন্দ্র রাও মাদ্রাজ প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের মি. গ্রিফিথকে রামানুজনের ব্যাপারে বলেন। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিংয়ের সঙ্গে মি. গ্রিফিথের আলাপ হওয়ার পর থেকেই রামানুজনের প্রতিভার স্বীকৃতি শুরু হয়। মাদ্রাজ শহরের বিশিষ্ট পণ্ডিত শেশা আইয়ার এবং অন্যান্যদের পরামর্শে কেমব্রিজের ত্রিনিত্রি কলেজের ফেলো জিএইচ হার্ডির সঙ্গে রামানুজন যোগাযোগ শুরু করেন এবং তাঁর বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একটি পত্র লেখেন। এই পত্রের সঙ্গে ১২০টি উপপাদ্য সংযোজিত ছিল। তার ভেতর থেকে নমুনাস্বরূপ হার্ডি ১৫টি নির্বাচন করেন। অনেক দিন ধরে হার্ডি রামানুজনকে তাঁর নিজের শহর ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। রামানুজনের অনেক বন্ধু ও হিতৈষীর প্রচেষ্টায় ১৯১৩ সালের মে মাসে মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের কেরানির দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং একটি বৃত্তি মঞ্জুর করা হয়। ঠিক এমন সময় তিনি কেমব্রিজ থেকে একটি আমন্ত্রণ পান। চাকরিগত সমস্যার সমাধান হলেও জাতিপ্রথা ও মায়ের অনুমতির অভাবে প্রথমে রামানুজন দেশের বাইরে যেতে অসম্মতি জানালেও পরে অপ্রত্যাশিতভাবে মায়ের সম্মতি পেলে তিনি কেমব্রিজে যান।
কেমব্রিজের আমন্ত্রণে বিদেশে আসার অল্প দিন পরই রামানুজন ত্রিনিত্রি কলেজের ফেলোশিপ পেয়ে যান। এই সময় রামানুজন আধুনিক গণিত সম্পর্কে ধারণা নেন।
এরপর রামানুজন অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। তার মধ্যে ল্যান্ডাউ-রামানুজন ধ্রুবক, রামানুজন-সোল্ডনার ধ্রুবক, রামানুজন-থিটা ফাংশন, রজার্স-রামানুজন আইডেনটিটি, রামানুজন প্রাইম, মক থিটা ফাংশন এবং রামানুজনের সমষ্টির কারণে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ১৯১৭ সালের বসন্তকালের শুরুতে রামানুজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে কেমব্রিজের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। এরপর তিনি আর কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেননি। তাঁকে ওয়েলস, ম্যালটক ও লন্ডন শহরের স্বাস্থ্যনিবাসে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক বছর তাঁর শারীরিক কোনো উন্নতি দেখা যায়নি।
এ সময় রামানুজন রয়্যাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। গবেষণার কাজে অধিক মনোযোগ দেওয়ার ফলে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান উপপাদ্যগুলো এ সময় আবিষ্কৃত হয়। তিনি নির্বাচিত ত্রিনিত্রি ফেলো ছিলেন। ১৯১৯ সালে রামানুজন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। রামানুজন অসুস্থ হয়ে যখন পুটনি হাসপাতালে ছিলেন, তখন হার্ডি ১৭২৯ নম্বরের ট্যাক্সিতে চড়ে তাঁকে দেখতে যান এবং তাঁর শয্যাপাশে বসে তাঁকে ওই সংখ্যার কথা বলেন, ‘আমার মতে ১৭২৯ সংখ্যাটি ভবিষ্যতের কোনো প্রতিকূল ঘটনার সংকেত।’ কিন্তু রামানুজন সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন, ‘না, ১৭২৯ একটি বিশেষ চিত্তাকর্ষক সংখ্যা। কারণ, এই সংখ্যা এরূপ ক্ষুদ্রতম সংখ্যা, যাকে দুটি ভিন্ন উপায়ে দুটি ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যার ঘনফলের সমষ্টিরূপে প্রকাশ করা যায়। এই ১৭২৯ সংখ্যা নিয়ে আরও জানতে পারবে গত সপ্তাহের গণিত ইশকুলে প্রকাশিত ‘হার্ডি-রামানুজন সংখ্যা’ লেখায়।
এই মহান গণিতবিদ বেশ কিছুদিন যক্ষ্মায় ভোগার পর ১৯২০ সালের ২৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তোমরা চাইলে ২০১৫ সালে রামানুজনকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘The Man Who Knew Infinity’ দেখতে পারো। আজ এখানেই শেষ করছি। রামানুজন ছিলেন গণিতের জগতে এক বিস্ময়। সারাটা জীবন তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সংখ্যার আশ্চর্য জগতে। এ লেখার মাঝে দেওয়া ছবিটিতে দেখে নাও রামানুজনের জীবন ও মৃত্যুর মধ্যেও লুকিয়ে থাকা সংখ্যার খেলা।