দৃষ্টিশক্তি হারানো ক্রিস্টিন কীভাবে মাস্টারশেফ হলেন
রান্না প্রতিযোগিতার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান মাস্টারশেফ ইউএসের তৃতীয় সিজনের বিজয়ী ক্রিস্টিন হা। শুধু তাই নয়, এ প্রতিযোগিতার প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রতিযোগীও ক্রিস্টিন। যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের ওয়েস্টার্ন গভর্নরস ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নিজের জীবনের গল্প শুনিয়েছেন এই মার্কিন লেখক ও রন্ধনশিল্পী।
জীবনের প্রথম সমাবর্তন বক্তৃতার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। চোখে দেখতে না পাওয়ার একটা সুবিধা হলো—আমার আজ পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে খুব একটা ভয় লাগছে না। কারণ, সামনে কত মানুষ বসে আছে দেখতে পাচ্ছি না, তাই ঘাবড়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই।
অনেকেই আমাকে চেনেন এক দশক আগে মাস্টারশেফ সিজন থ্রি-জয়ী প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রন্ধনশিল্পী হিসেবে। কিন্তু আজ আমি আমার ‘মাস্টারশেফ’-এর সময়ের আগের গল্প শোনাতে এসেছি। আজ শোনাব কীভাবে আমার জীবনের পথ এঁকেবেঁকে অনেক চড়াই-উতরাই, হোঁচট আর আঘাত সামলে এ পর্যন্ত এল।
পড়াশোনার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি
গল্পের শুরুটা হয় আমার জন্মের আগে থেকে। ১৯৭৫ সালে আমার মা-বাবা ভিয়েতনাম থেকে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মানসিক ও আর্থিকভাবে বিধ্বস্ত আমার পরিবারের কাছে কয়েকটা পুরোনো কাপড় ছাড়া আর কিছু ছিল না। এখানে এসে আমার মা-বাবা একেবারে শূন্য থেকে জীবন শুরু করেন। কয়েক বছর পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার জন্ম। আর বেড়ে ওঠা হিউস্টনে।
ছোটবেলা থেকেই আর সবার মতো আমার মা-বাবার কাছেও পড়াশোনার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি ছিল। এখনো মনে আছে, ঠিকমতো লিখতে শেখার আগেই মা-বাবা আমাকে একটা ছোট্ট সবুজ টেবিল কিনে দিয়েছিলেন। যেটায় আমি ছবি আঁকতে আঁকতে লিখতে শিখি, পড়তে শিখি। পড়াশোনার ব্যাপারে আমার পরিবার বেশ কঠোর ছিল। পরীক্ষায় ‘এ’ পাওয়ার পর আমি মায়ের হাতে রিপোর্ট কার্ড দিলে তাতে চোখ বুলিয়ে সবার আগে তিনি বলতেন, ‘কী অবস্থা! এ+ কেন পাওনি?’ আমি মাকে বলতাম, ‘আমার বন্ধুরা এ পেলে ওদের বাড়ি থেকে এক-দুই ডলার উপহার দেয়। আমার উপহার কোথায়?’ তখন মা বলতেন, ‘এ+ না পেলে বকা ছাড়া তুমি আর কিছুই পাবে না।’ বুঝতেই পারছ, পড়াশোনা আমার কাছে কতটা চাপের ব্যাপার ছিল।
ভাতও রাঁধতে জানতাম না
এবার আমার তরুণ বয়সে আসি। কলেজ শেষ করে বিজনেস ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছি। মজার ব্যাপার হলো, পরিবারের চাপের কারণে আমি লেখাপড়ায় এতটাই বুঁদ থাকতাম যে ওই বয়সেও আমি ভাত সেদ্ধ করতে জানতাম না। ছাত্র হিসেবে তুখোড় হলেও রান্নাবান্নায় ছিলাম ‘জিরো’। এশীয় হয়েও ভাত রাঁধতে জানি না, বিষয়টা আমার কাছে খুব বিব্রতকর ছিল।
তাই কলেজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর যখন ডরমিটরিতে থাকা শুরু করলাম, তখন ঠিক করলাম নিজে নিজে রান্না শিখব। একে তো রোজ রোজ কিনে খাওয়ার মতো অত টাকা আমার নেই, তার ওপর ঘরের খাবার না খেলে কিছুতেই আমার মন বসে না। তাই ডর্মে উঠেই হাঁড়ি-পাতিল-কড়াই-খুন্তি কিনে আগে রান্নাঘর সাজালাম। এরপর কিনলাম ভিয়েতনামের খাবারের রেসিপির বই।
আমার বয়স যখন ১৩, তখন মা মারা যান। তাই মায়ের কাছ থেকে ভিয়েতনামের কোনো ঐতিহ্যবাহী রান্না আমার শেখা হয়নি। রেসিপির বই-ই ছিল একমাত্র শিক্ষক। একটা সময় ছিল, যখন মায়ের হাতের মাছ, সবজি খেতে একঘেয়ে লাগত। কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলাম, ডর্মে একা থাকা শুরু করলাম, তখন থেকে মাকে আর মায়ের হাতের রান্নাকে ভয়ংকরভাবে মিস করতে শুরু করলাম। ওই সময় রান্নার বই আর আমার টুকটাক রান্নার চেষ্টায় আমি মাকে খুঁজে পেতাম।
শুরুতে বেশ বাজে রান্না করতাম। আমার রান্না আমিই মুখে তুলতে পারতাম না! কিন্তু হাল ছাড়িনি। একটু একটু করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলাম। একদিন ঠিক করলাম বন্ধু আর রুমমেটদের রেঁধে খাওয়াব। রেসিপির বই ঘেঁটে সবচেয়ে সহজ আর কম উপকরণের রান্না খুঁজে বের করলাম। ভয়ে ভয়ে রান্না করলাম। ওরা একদম চেটেপুটে খেল, কিছু বাকি রাখল না। ওদের তৃপ্তিভরা অভিব্যক্তি দেখে নিজেও বেশ শান্তি পেয়েছিলাম। নিজ হাতের রান্না, নিজের সৃষ্টি দিয়ে মানুষকে খুশি করতে পারার অনুভূতি ছিল আমার কাছে নতুন। এরপর আমি নিয়মিত রান্না শুরু করি।
দৃষ্টিশক্তি হারানো ও ভুল চিকিৎসা
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর কয় দিন পর থেকে আমার চোখের সমস্যা শুরু হয়। চিকিৎসকের কাছে গেলে আমাকে বলা হলো নিউরোলজিক্যাল সমস্যার কারণে এটা হচ্ছে। প্রথম চার বছর ভুল চিকিৎসার কারণে আমার অসুখটা আরও বেড়ে যায়। চার বছর পর ধরা পড়ে, আমার আদতে নিউরোমায়লেটিস বা এনএমও নামে একটা অসুখ হয়েছে, যার ফলে চোখের শিরাগুলো ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে গেছে।
মনে আছে, এ অসুখের কারণে আমার একটা ভয়াবহ অ্যাটাক হয়েছিল। চার দিন শরীর অবশ হয়ে ছিল। ঘাড়ের নিচে কোনো কিছু টের পাইনি। ওটা ছিল জীবনের কঠিনতম সময়। আমাকে আমার করপোরেট ক্যারিয়ার ছাড়তে হয়েছিল, গোছানো সচ্ছল জীবন হারাতে হয়েছিল। আমি নড়তে পারতাম না, উঠে বসতে পারতাম না, এক গ্লাস পানিও নিজ থেকে খেতে পারতাম না। চোখে দেখতে পেতাম না। লম্বা সময় লেগেছিল স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। ওই সময় শারীরিক ও মানসিক থেরাপির পাশাপাশি পরিবার আর বন্ধুরা আমাকে অনেক সাহস দিয়েছে, পাশে থেকেছে।
যে গল্পের দুনিয়া আমাকে অন্ধকার সময়েও আলো দেখিয়েছে, ঠিক করলাম সেই দুনিয়াতেই স্থায়ী হব। তাই ঠিক করলাম ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে স্নাতকোত্তর করব, আবার পড়াশোনায় ফিরে যাব। এর মধ্যে শুরু হলো মাস্টারশেফের অডিশন।
ওই সময় আমার ভালো থাকার অন্যতম সঙ্গী ছিল বই। চোখে দেখতে পারতাম না বলে সারা দিন অডিও বই শুনতাম। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা। বই পড়ে পড়ে গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুতা করতাম। গল্পের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে আমার কী যে ভালো লাগত! তাই কঠিন সময়ে বই পড়ার পুরোনো অভ্যাসটা আশীর্বাদের মতো কাজ করল। যন্ত্রণার সময়গুলো ভুলে থাকার জন্য আবার বইয়ের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে থাকলাম, কাল্পনিক চরিত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলতে থাকলাম। যদিও আমি আর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাইনি, তবে প্যারালাইসিস থেকে সেরে ওঠার পর আমি ব্রেইল ব্যবহার করা শিখলাম, সাদাছড়ি নিয়ে হাঁটা শিখতে শুরু করলাম, নিজের নতুন বাস্তবতাকে একটু একটু করে গ্রহণ করতে থাকলাম।
যে গল্পের দুনিয়া আমাকে অন্ধকার সময়েও আলো দেখিয়েছে, ঠিক করলাম সেই দুনিয়াতেই স্থায়ী হব। তাই ঠিক করলাম ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে স্নাতকোত্তর করব, আবার পড়াশোনায় ফিরে যাব। এর মধ্যে শুরু হলো মাস্টারশেফের অডিশন। ভাবলাম, জীবনে তো অভিজ্ঞতা কম হলো না। এবার না হয় ন্যাশনাল টিভিতে গর্ডন র্যামোসের মতো শেফের কাছ থেকে বকা খাওয়ার অভিজ্ঞতাটাও নিই। ভাবতেও পারিনি মাস্টারশেফের ট্রফি জিতব। ভেবেছিলাম রান্নার ব্যাপারে আরও একটু গভীরভাবে জানব, কিছু অভিজ্ঞতা নেব, নতুন গল্প পাব, আর এসবকে পুঁজি করে একটা দারুণ বই লিখব। এটাই হবে আমার ট্রফি। কিন্তু সবাইকে এবং সেই সঙ্গে নিজেকেও অবাক করে দিয়ে আমি মাস্টারশেফ জিতে গেলাম। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, সেখান থেকে বেরিয়ে আমার লেখা রান্নার বই নিউইয়র্ক টাইমস–এর বেস্টসেলার লিস্টেও উঠে গেল! আমার কাজিন যখন আমাকে বেস্টসেলার লিস্টের কথা বলছিল, তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এরপর রান্না নিয়ে আমি দেশ-বিদেশ ঘুরতে শুরু করলাম, নিজের দুটো রেস্তোরাঁ চালু করলাম, নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করলাম, নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করতে থাকলাম আর আমার মতো বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টির কাজে যোগ দিলাম।
আমাদের সবার গল্প একই রকম
আমার গল্প শুনে মনে হতে পারে, এ গল্পের সঙ্গে তোমাদের গল্পের কোনো মিল নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, একটু গভীরভাবে খেয়াল করলেই বুঝবে আমাদের সবার গল্পই কোনো না কোনোভাবে একই রকম, চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। আমাদের সবাইকে জীবনের নানা সময়ে নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। কারও কাছে এ প্রতিকূলতা আমার মতো কোনো শারীরিক সীমাবদ্ধতা, কারও কাছে মানসিক, কারও প্রতিকূলতা পারিবারিক সংকট, কারও আবার আর্থিক। আমরা সবাই কোনো না কোনো লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। একটা লড়াই শেষ হয়, তো আরেকটা শুরু। কিন্তু যে লড়াই-ই আমরা লড়ি না কেন, মোদ্দা কথা হলো—আমরা কোনোটাতেই যেন হার না মানি। গত দুই বছর তোমরা বৈশ্বিক মহামারির সঙ্গে লড়াই করে অনেক কিছু হারিয়ে আজ এ সমাবর্তন পর্যন্ত এসেছ। তোমাদের অভিনন্দন। সামনের দিনগুলোতেও এ অর্জনটাকে মনে রেখো। আমার মা-বাবার মতে, জীবনে শিক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি নিজের জীবনের উপলব্ধি থেকে বলতে চাই, শুধু পড়ালেখা নয়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, অর্জন আর হোঁচটগুলোও অনেক জরুরি। এখন তোমাদের কাছে শিক্ষা আছে, সেই সঙ্গে একটা মহামারিকে মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতাও আছে। তোমরা অন্য অনেক প্রজন্মের চেয়েও বেশি অপ্রতিরোধ্য। তাই এ কথা মনে গেঁথে নাও, আর বিশ্বজয়ে নেমে পড়ো।