পদ শূন্য, মাধ্যমিকে সংকট

সহকারী শিক্ষক থেকে উপপরিচালক পর্যন্ত ২২ শতাংশ পদ শূন্য। আটকে আছে শিক্ষক পদে ২,১৫৫ নিয়োগ।

সূত্র: মাউশি

দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনে শূন্য পদগুলো পূরণ হচ্ছে না। সহকারী শিক্ষক থেকে উপপরিচালক পর্যন্ত প্রায় ২২ শতাংশ পদই শূন্য। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষকের পদই প্রায় ২০ শতাংশ শূন্য। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী দক্ষতা ও মানের ঘাটতি নিয়েই বেড়ে উঠছে।

কয়েকটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীর তুলনায় এমনটিতেই পদসংখ্যা পর্যাপ্ত নয়, সেখানে এত পদ শূন্য রেখে মানসম্মত শিক্ষা দূরের কথা, স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়াই দুরূহ ব্যাপার।

বিদ্যালয়গুলো যখন শিক্ষকসংকটে ধুঁকছে, তখন দীর্ঘসূত্রতার কারণে তিন বছরেও দুই হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ শেষ করতে পারেনি সরকার। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকসংকট দূর করতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে ২ লাখের বেশি প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। পরীক্ষা শেষে গত বছরের ডিসেম্বরে ২ হাজার ১৫৫ জন প্রার্থীকে সহকারী শিক্ষক ও শিক্ষিকা পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুপারিশ পাওয়া এসব প্রার্থী নিয়োগের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজ দেরি হওয়ায় নিয়োগও দেরি হচ্ছে।

মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আশা করছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই সহকারী শিক্ষক নিয়োগ হয়ে যাবে। এ ছাড়া উপপরিচালক, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শূন্য পদ পূরণের জন্যও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সব স্তরেই শিক্ষকের শূন্য পদ

জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মাধ্যমিক) ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একমাত্র পিয়ন বদলি হয়েছে, তাই জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। প্রধান শিক্ষক-কাম দপ্তরি-কাম পিয়ন-কাম দারোয়ান-কাম সুইপার-কাম ঝাড়ুদার-মালি।’ গতকাল শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির পদ আছে ১০টি। এর মধ্যে ৫টি এমএলএসএস (পিয়ন) পদে কেউ নেই। অন্যান্য পদের মধ্যে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন, তিনিও অসুস্থ।

শূন্য পদের বিষয়টি শুধু শহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিত্রও প্রায় একই রকম। নোয়াখালীর হাতিয়ার ওছখালী কে এস এস সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৫০ জন। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকের ২৫টি অনুমোদিত পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৬ জন শিক্ষক। বাকি ১৯টি পদই শূন্য। নিরুপায় হয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৫ জন ‘অতিথি শিক্ষক’ রেখেছেন। এ বাবদ খরচের অর্থ মূলত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক রাহাতে জান্নাত মোসা. ফেরদাউস।

মাউশির সূত্রমতে, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে সহকারী শিক্ষক ও শিক্ষিকার পদে অনুমোদিত পদ আছে ১০ হাজার ৯০৮টি। এর মধ্যে গত নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ১৮০টি পদ শূন্য ছিল। সংকট নিরসনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিষয়ভিত্তিক পদ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাঈদ ভূঁইয়া।

প্রধান শিক্ষকের প্রায় ৭০ শতাংশ এবং প্রধান শিক্ষিকার প্রায় ৬৬ শতাংশ পদ শূন্য। এ ছাড়া সহকারী প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকার পদ শূন্য রয়েছে যথাক্রমে ১৫ শতাংশ ও ২৪ শতাংশ।

রাজধানীর একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রধান শিক্ষিকা প্রথম আলোকে বলেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারী শিক্ষকদের চেয়ে তাঁদের কোটা কম। ফলে একই সময়ে যোগ দিয়েও তাঁদের মতো অনেকে পদোন্নতিতে পিছিয়ে থাকেন। তাই এই নিয়ম বদলানোর দাবি জানান তিনি।

সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষকের সংকট, বিশেষ করে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংকট প্রকট। এর ফলে সংখ্যার পাশাপাশি মানের দিক থেকে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও এটি বড় অন্তরায়। তাই এই সংকট দূর করতে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে মনোযোগ দেওয়া দরকার।
এস এম হাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো কার্যত ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পদ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনেক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তরেও পড়ানো হয়। এমনকি অন্তত ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও পড়ানো হয়। কিন্তু সেই তুলনায় শিক্ষকের পদ বাড়েনি।

প্রশাসনিক পদও শূন্য

মাউশির অধীন দেশের ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু মাউশির সূত্রে জানা গেছে, উপপরিচালকের ১০টি পদের সব কটিই শূন্য। এগুলো চলছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে। সহকারী পরিচালকের দুটি পদেও একই অবস্থা। বিদ্যালয় পরিদর্শক ও পরিদর্শিকার ১৬টি পদ এবং সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ও পরিদর্শিকার সমপরিমাণ পদও চলছে প্রায় একইভাবে। এ ছাড়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ৬৪টি পদের মধ্যে ৩১টি এবং সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ১৩টি পদ শূন্য।

মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, নির্ধারিত পদে নির্ধারিত সময় চাকরির অভিজ্ঞতা (ফিডার সার্ভিস) সংক্রান্ত কিছু জটিলতার কারণে এসব পদ পূরণ হচ্ছে না। অথচ অনেক প্রধান শিক্ষক আছেন, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে একই পদে চাকরি করছেন। কিন্তু তাঁদের উপপরিচালক পদে নিয়মিত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। উপপরিচালক পদে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও মধ্যেও কেউ কেউ চাকরির শেষ পর্যায়ে আছেন।

মাধ্যমিক স্তরটি শিক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তর যত পোক্ত হবে, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার স্তরটিও তত শক্ত হবে। এ জন্য মাধ্যমিকের সংকটগুলো দূর করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষকের সংকট, বিশেষ করে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংকট প্রকট। এর ফলে সংখ্যার পাশাপাশি মানের দিক থেকে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও এটি বড় অন্তরায়। তাই এই সংকট দূর করতে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে মনোযোগ দেওয়া দরকার।