বাঙালির মুক্তির সনদ

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
ফাইল ছবি

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশ পরিচালনার ঘোষণা দেন। জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযোগিতার নির্দেশ দিয়ে তিনি তাঁর ভাষণে কোর্ট-কাচারি, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। আমরা জানি, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালিত হয় জনগণের ট্যাক্স বা খাজনায়। তিনি তাঁর ভাষণে আরও বলেন, ‘যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হচ্ছে তত দিন খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো।’

বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া ও তার সহযোগী ভুট্টোর কর্মকাণ্ড দেখে বুঝেছিলেন, এরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তিনি এক দিকে আলোচনা, অন্য দিকে চূড়ান্ত সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য জাতিকে প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। প্রয়োজনে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ বক্তৃতার এক জায়গায় তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এ কথায় গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মুক্ত করার প্রকাশ্য নির্দেশনা পাওয়া যায়। দশ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি তাঁর এ বক্তৃতায় ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করে ভবিষৎ নতুন রাষ্ট্রের নামকরণ চূড়ান্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সরাসরি স্বাধীনতার কথা না বললেও বাঙালিকে তিনি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেন। বক্তৃতার শেষ অংশে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দিয়ে তিনি স্পষ্টভাবেই স্বাধীনতার ডাক দেন। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ উন্মুক্ত করতে ইয়াহিয়া ঘোষিত ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের ব্যাপারে ৪টি পূর্বশর্ত ঘোষণা করেন।

১. সামরিক আইন প্রত্যাহার।

২. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর

৩. সেনাবাহিনীর গণহত্যার তদন্ত।

৪. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া।

এ দাবিগুলো মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তিনি অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মর্চের ভাষণ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। এ ভাষণ সারা দেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। তাদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এ ভাষণ যেন জাদুর স্পর্শে বাঙালি জাতিকে বীরের জাতিতে রূপান্তরিত করেছে। তাই অনেকেই মনে করেন, এ ভাষণ বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ইউনেস্কো ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টরি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ভাষণ ইন্টারন্যাশনাল ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টরি ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কো অন্তর্ভুক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীর একমাত্র অলিখিত ভাষণ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

তথ্যসূত্র: অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যবই