হাল্ট প্রাইজের প্রাপ্তি ও শিক্ষা

বাঁ থেকে রাফিক ইসলাম, মাজবাহুল ইসলাম ও ফয়সাল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
বাঁ থেকে রাফিক ইসলাম, মাজবাহুল ইসলাম ও ফয়সাল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

‘হাল্ট প্রাইজ’কে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যবসায় উদ্যোগ প্রতিযোগিতা। যৌথভাবে যার আয়োজক জাতিসংঘ ও বিল ক্লিনটন ফাউন্ডেশন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম হাফিংটন পোস্ট এই প্রতিযোগিতার নাম দিয়েছে ‘শিক্ষার্থীদের নোবেল পুরস্কার’। প্রতিবছর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের আহ্বানে বহু শিক্ষার্থী একটি নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই প্রতিযোগিতার সুবাদে। সমস্যার সমাধান ও সেই সমাধান থেকে ব্যবসার সুযোগ তৈরি করার জন্য পুরস্কার হিসেবে বিজয়ী দলকে দেওয়া হয় ১ মিলিয়ন ইউএস ডলার (সাড়ে ৮ কোটি টাকা)।

এই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীদের পেরোতে হয় চারটি পর্ব। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের দল হাল্ট প্রাইজে অংশ নিচ্ছে। বিশ্বের প্রায় দুই লাখের বেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে লড়াই করে এ বছর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) দল ‘সেফহুইল’ জায়গা করে নেয় একদম চূড়ান্ত পর্বে, শীর্ষ ছয়টি দলের একটি হয়ে। ‘সেফহুইল’-এর সদস্যরা হলেন বিইউপির ডিপার্টমেন্ট অব মার্কেটিংয়ের শেষ বর্ষের তিন শিক্ষার্থী—রাফিক ইসলাম, মাজবাহুল ইসলাম ও ফয়সাল ইসলাম।

তিন চাকায় পথচলা

এবারের নির্বাচিত সমস্যা ছিল, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ১০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করা। যার সমাধানকল্পে বাংলাদেশি তিন তরুণ উপস্থাপন করেন ‘সেফহুইল’ প্রকল্প। ‘সেফহুইল’ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে স্বল্প খরচে জরুরি চিকিৎসাসেবাকারী একটি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে ভুগছেন প্রায় ১০ কোটি মানুষ। আর অ্যাম্বুলেন্স যদি পাওয়াও যায়, তার খরচ জোগানোর সামর্থ্য থাকে না স্বল্প আয়ের গ্রামবাসীর। তাই সেফহুইল তাদের তিন চাকার সুলভ অ্যাম্বুলেন্স সেবার পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছিল হাল্ট প্রাইজে।

 ‘প্রতিযোগিতার শুরুতে ক্যাম্পাস রাউন্ডে যখন অংশগ্রহণ করেছিলেন, ভেবেছিলেন এত দূর যাবেন?’ প্রশ্ন শুনে রাফিক হেসে জানালেন, এই ভাবনা তাঁদের ছিল। ‘হাল্ট প্রাইজ নিয়ে আমাদের আগ্রহ অনেক আগে থেকে। প্রথম বর্ষে “হাল্ট প্রাইজ”-এ প্রতিযোগিতা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হতো না। আমি আর ফয়সাল নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম, আমাদের এখানে প্রতিযোগিতাটি হলে আমরাও অংশগ্রহণ করব, অনেক দূর যাব। সুতরাং বলা চলে, হ্যাঁ। প্রাথমিক পর্যায়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, একবার এই পর্যায় পার করতে পারলে পরবর্তী পর্যায়ে যতটুকু পরিশ্রম দরকার; তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি আমাদের ছিল।”’

অভিজ্ঞতাও বড় পাওয়া

‘হাল্ট প্রাইজ-২০১৯’-এ চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয় মেক্সিকোর দল ‘রুতোপিয়া’। কয়েকটি প্রাথমিক পর্বে প্রথম হলেও চূড়ান্ত পর্বে প্রথম হতে পারেনি ‘সেফহুইল’। ফলাফল ঘোষণার আগের ও পরের অনেকটা সময় শরীরে বাংলাদেশের পতাকা জড়িয়ে রাখা ফয়সালের কণ্ঠে কিছুটা আক্ষেপ আছে বৈকি, ‘ফাইনালের ফলাফলের পর শূন্যতা কাজ করেছে কিছুটা। যত কিছুই হোক, এত বড় জায়গায় নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। খারাপ লেগেছে, মিথ্যা বলে লাভ নেই। তবে মেক্সিকোর “রুতোপিয়া” সত্যিই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্য। তাঁদের অভিনন্দন জানাতেই হয়।’

হাল্ট প্রাইজের চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগীরা।
হাল্ট প্রাইজের চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগীরা।

এই দীর্ঘ যাত্রাটা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতাই হয়ে থাকবে তিন তরুণের কাছে, ‘সামনে বসে যখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মানুষেরা আমাদের কথা শুনছিলেন, তখনকার অনুভূতি প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় শব্দ জানা নেই আমার। জাতিসংঘে গ্লোবাল ফাইনালের সেই ১১ মিনিটের পরিবেশনাই হয়তো আমার জীবনের সেরা ১১ মিনিট হয়ে থাকবে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা শুরু করে দিলাম, বাংলাদেশ এরপরের প্রতিবার হাল্ট প্রাইজে একটা উল্লেখযোগ্য নাম হয়ে থাকবে’, বলছিলেন মাজবাহ। জানিয়ে রাখি, জাতিসংঘের নিউইয়র্ক কার্যালয়ে সেফহুইল বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে গত ১৪ সেপ্টেম্বর। এই পর্বে বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ৫৫তম ম্যাক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ভিনসেন্ট ফক্স কুয়েসাদা, জাতিসংঘের গ্লোবাল কমপ্যাক্ট সিইও লিসে কিংসহ আরও অনেক বিখ্যাত জন।

ভুল থেকে শেখা

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এত বড় একটি প্রতিযোগিতায় গিয়ে ভালো করতে হলে সবচেয়ে বেশি কী প্রয়োজন? এই প্রশ্নের উত্তরে ফয়সাল বললেন, সবার আগে প্রয়োজন এ ধরনের প্রতিযোগিতা যেন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরও বেশি আয়োজিত হয়, তা নিশ্চিত করা। রাফিকের মতে, ‘যদি বিশেষ করে হাল্ট প্রাইজের কথা বলি, এই প্রতিযোগিতাকে অন্য সব প্রতিযোগিতার মতো করে না দেখে নিজেদের ব্যবসা বাস্তবায়নের সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত প্রতিযোগীদের।’

‘আইডিয়ার কোনো মূল্যই নেই, যদি তা বাস্তবায়নের সুযোগ না থাকে। মার্কেট রিসার্চ, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, প্রোডাক্ট ফিজিবিলিটি, রেভিনিউ মডেল, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—সবকিছুর দিকে নজর রাখতে হবে। বিভিন্ন চলমান ব্যবসা উদ্যোগ প্রতিযোগিতাগুলোতে আমরা আইডিয়াকে যত গুরুত্ব দিই, এসব বিষয়কে দিই না—এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। এ বছরের হাল্ট প্রাইজে চ্যাম্পিয়ন দল রুতোপিয়া তাদের ব্যবসা নিয়ে কাজ করছে দুই বছর ধরে। এই জিনিসটাই তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। তারা মাঠে নেমেছে, তারা জানে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল বাধাগুলো কী কী। আমরা এই দিকটাতেই হয়তো পিছিয়ে ছিলাম।’ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা রাফিকের সঙ্গে যোগ করে দিলেন মাজবাহ।

চ্যাম্পিয়ন না হতে পারলেও সেফহুইলের যাত্রা এখানেই শেষ নয়। সেফহুইলের সদস্যদের মতে—কেবল শুরু। এই ব্যবসাকে বাস্তবে রূপ দিতে, প্রান্তিক গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষের দুয়ারে দুয়ারে অ্যাম্বুলেন্স সেবা পৌঁছে দিতে, মাঠে নেমে পড়েছেন এই তিন তরুণ। আপাতত পরিশ্রম আর স্বপ্নই তাঁদের পুঁজি।