আমাদের সিনেমা কানে যেতে পারে

কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফরাসি গণমাধ্যম ফ্রান্স টোয়েন্টিফোরের কাছে ধরা দিলেন নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। আলাপে উঠে এল ছবিটি তৈরির পেছনের গল্প।

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

কানের অফিশিয়াল সিলেকশনের অংশ হয়ে কেমন লাগছে? এই খবরে দেশে কীভাবে শুভেচ্ছায় সিক্ত হলেন?

এখানে আসতে পারাটা দারুণ অনুপ্রেরণার আর বিশাল সম্মানের বিষয়। একটা ছবি বানাতে প্রচুর ত্যাগ, নিষ্ঠা, সময় ও শ্রম লাগে। এ রকম কিছু একটা যখন ঘটে, তখন সামনের দিকে পথ চলতে সত্যিই এটা প্রেরণা জোগায়।
এই খবরে দেশের সবাই অভিভূত। এটা আমার থেকেও তাঁদের কাছে বড় অর্জন। এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হলো। সুতরাং সবার কাছে এই খবর আরও বেশি আনন্দের হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি সিনেমা নির্মাণে আরও বেশি আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাদ ও তার ছবি রেহানা

প্রশ্ন :

স্বাধীন ধারার নির্মাতা হিসেবে এই ছবিতে অর্থ লগ্নি করা কতটা কঠিন ছিল?

প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে তুলনা টানলে অবশ্যই বাংলাদেশে অনেক চ্যালেঞ্জ। তবে ছবির জন্য অর্থ জোগাড় ও রকম কোনো চ্যালেঞ্জ না। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে ছবি বানাতে ভালোবাসি, যেভাবে আমার আগের ছবিটি বানিয়েছি। আমি ভাগ্যবান যে প্রযোজক হিসেবে জেরেমি চুয়াকে পেয়েছি। তিনি ছবির স্ক্রিপ্ট লেখায় বেশ সাহায্য করেছিলেন।

আমার কেন্দ্রীয় অভিনেত্রী মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন, যা আমরা চেয়েছি, তাই তিনি দিয়েছেন। আমার চিত্রগ্রাহক এক বছরের বেশি সময় ধরে জিমে গিয়েছিলেন। কারণ, তাঁকে বলেছিলাম, এই ছবির জন্য তাঁকে ফিট হতে হবে। কারণ, এই ছবিতে প্রচুর দীর্ঘ শট ও ক্যামেরা হাতে শট আছে। পুরো দল আমাকে কীভাবে সহযোগিতা করেছে, এটা তার ছোট্ট কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।

প্রশ্ন :

আপনার ছবি আকর্ষণীয় এক চরিত্র বিশ্লেষণ। এই চরিত্রটি আপনি কোথায় পেয়েছেন?

বড় তিন বোনের সঙ্গে আমি বেড়ে উঠেছি। তাঁরা খুবই সাহসী, সুন্দর, দৃঢ়চেতা ও বুদ্ধিমতী। সব সময়ই তাঁরা আমাদের পরিবারকে আধিপত্য করেছে। আমার ওপর তাঁদের দারুণ প্রভাব আছে। খুব কাছ থেকে তাঁদের আমি দেখেছি, কীভাবে তাঁরা কন্যা থেকে বোন এবং তারপর মা ও পেশাদার হয়ে উঠেছেন। সব সময়ই এটি আমার কাছে আকর্ষণীয় একটা বিষয়। একরোখা নারীর যে ভাবমূর্তি আমার মধ্যে আছে, সেখান থেকেই পুরো প্রকল্পটার শুরু। আমি শুধু দেখতে চেয়েছি আসলে সে কিসে গড়া, কত দূর পর্যন্ত তাকে ঠেলে দেওয়া যায় আর দেখা সে কেমন ধরনের মানুষ।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির প্রিমিয়ারে পরিচালক, প্রযোজক ও কলাকুশলী
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

এ রকম জটিল, নৈতিকভাবে পরস্পরবিরোধী চরিত্র তৈরি কি আপনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

আমার ছবিটি আসলে মানুষের প্রকৃতিকে অনুসন্ধান করে। আমি রাজনৈতিক কোনো প্রেক্ষাপটে ছবির গল্প লিখিনি। অবশ্যই ছবিতে রাজনৈতিক একটা দিক আছে। কিন্তু নিজেকে আমি রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে ভাবি না। আমি খুবই চরিত্রকেন্দ্রিক কাজ করি। এই ধরনের চরিত্র এবং সে কতটা জটিল—এটা আমাকে সব সময় টানে। আমি কখনোই তাঁকে একটা আন্দোলনের হিরো অথবা বিজয়ী হিসেবে রূপায়ণ করার চেষ্টা করিনি। তবে একজন ব্যক্তি হিসেবে এবং কীভাবে তিনি সমসাময়িক বিশ্বকে দেখেন, সেটা বেশি দেখাতে চেয়েছি।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রযোজক চুয়া, অভিনেত্রী বাঁধন, পরিচালক সাদ ও প্রযোজক বাবু। ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

এটা কি আপনাদের দেশের নির্দিষ্ট কিছু অভিজ্ঞতা? যা আপনি বলতে চেয়েছেন?

অবশ্যই, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে আমি কিছুই লিখতে পারি না। সুতরাং যে চরিত্রই রূপায়ণ করি, কোনো না কোনোভাবে এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে কিংবা পর্যবেক্ষণ করেছি আমাদের দেশে। কিন্তু আমি অবশ্যই চেয়েছি শুধু আমার দেশের দৃষ্টিকোণে নয়, সবাই যেন এই চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। আমার কোনো বন্ধু যখন বলে, এটা যেকোনো জায়গায় ঘটতে পারে, হোক ফ্রান্স কিংবা ইউরোপের কোথাও, আমার মনে হয়েছে, সম্ভবত আমি সঠিক জায়গাটা স্পর্শ করতে পেরেছি, যেখানে মনে হবে এই ঘটনা যেকোনো জায়গায়ই ঘটতে পারে।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনার ছবির মূল অভিনেত্রীর নিষ্ঠার কথা বলেছেন। চরিত্রটি তৈরিতে নিজেকে তিনি কতটা জড়িয়েছিলেন?

প্রথমবার যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করি এবং চরিত্রটি নিয়ে আলাপ করি, তখন আমার কাছে পুরো চিত্রনাট্য ছিল না। আমার মহড়া শুরু করি, তাঁর চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে থাকি। আমি তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গে ইমুর (ছবিতে তাঁর মেয়ে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আফিয়া জাহিন জাইমা) সম্পর্কটা পর্যবেক্ষণ করি। আমি তাঁদের জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছি, যেখানে তাঁরা নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারেন এবং যোগযোগ তৈরি করতে পারেন।


অবশ্যই বাঁধনের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চূড়ান্ত চিত্রনাট্যে খুবই প্রভাব ফেলেছিল। কারণ, তিনিও একজন সিঙ্গেল মা। নয় বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে তাঁর। আমি দেখেছি তাঁরা দুজন কীভাবে কথাবার্তা বলেন। এই চরিত্রের জন্য তিনি নয় মাস মহড়া করেছিলেন। বাইরের সবকিছু পাশে ঠেলে রাখে। তবে আর্থিকভাবে আমরা তাঁকে যথেষ্ট প্রতিদান দিতে পারিনি। কিন্তু তিনি সত্যিই ভেবেছিলেন, এই ছবিটি তিনি করতে চান এবং পুরো ছবিটি তাঁর কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

কান–এ আজমেরী হক বাঁধন
বাঁধনের সৌজন্যে

প্রশ্ন :

আপনি কি আশা করেন, কান স্পটলাইট বাংলাদেশি ছবির প্রতি আরও বেশি আগ্রহ তৈরি করবে?

ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব বেশি মনযোগ চাই না। যতটা পারা যায় আড়ালে থাকতে পছন্দ করি। আমি জনপ্রিয়তার আলোয় থাকতে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। অবশ্যই এই অর্জন আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক সাহায্য করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বাধীন ধারার নির্মাতাদের এটা খুবই অনুপ্রেরণা দেবে। আমি অনেকের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, যাঁরা এখন সত্যিই বিশ্বাস করে আমাদের সিনেমা কানে যেতে পারে, এর আগে যা ছিল কেবলই স্বপ্ন। আমি মনে করি, এটা আমাদের সিনেমার একটা বিশাল অর্জন, আমার চলচ্চিত্র সঙ্গীদের জন্য একধরনের পরম্পরা।

২০১৮ সালে বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেটে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, প্রযোজক জেরেমি চুয়া এবং সহ–প্রযোজক রাজীব মহাজন
ছবি : সংগৃহীত

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন: বেঞ্জামিন ডডম্যান