‘একটি জীবনই যথেষ্ট’

সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সাক্ষাৎকার অনেকবার নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে ভারতীয় সাংবাদিক খালিদ মোহাম্মদের। তবে শেষ সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনের নানা অজানা দিক খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেছেন লতা।দুই বছর আগে এ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন খালিদ, ল্যান্ডফোনে দুই পর্বে। খালিদ বলেছেন, এই বয়সেও লতার কণ্ঠস্বর ছিল বরাবরের মতোই রেশমমসৃণ। গতকাল রোববার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য কুইন্ট-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

লতা মঙ্গেশকর, ১৯৯৯ সালের ২৮ এপ্রিল ভারতের মুম্বাইয়ে এক অনুষ্ঠানে
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

খালিদ মোহাম্মদ: আপনি কি আপনার গত সাত দশকের অর্জনগুলোর দিকে কখনো ফিরে তাকিয়েছেন? সেখানে কি বেদনাদায়ক কিছু আছে? কোনো অপূর্ণ ইচ্ছা? কোনো তৃপ্তির অনুভূতি?

লতা মঙ্গেশকর: আমি খুব বেশি চিন্তাভাবনার মানুষ বলে নিজেকে বিবেচনা করি না। অতীতে বাস করে লাভ নেই। আত্মপ্রেমী মানুষই কেবল আজ ও আগামীকালকে উপেক্ষা করে অতীত নিয়ে পড়ে থাকেন। যত দিন আমার কণ্ঠস্বর আমাকে ছেড়ে না যাচ্ছে, তত দিন আমি গান গেয়ে যেতে চাই। গানই একমাত্র বিষয়, যা আমি পারি।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনি কি পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের গায়িকা নূরজাহানের গায়কিতে প্রভাবিত হয়েছিলেন?

লতা: হ্যাঁ, আমাকে তাঁর সঙ্গে তুলনা করা হতো। আমি স্বীকারও করব যে তাঁর গান শোনার পর তাঁর গায়কি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনি কি আপনার গানের সংগ্রহ ডিজিটাইজ করে সংরক্ষণ করেছেন?

লতা: আমি আমার সব ভিনাইল রেকর্ড, ক্যাসেট আর সিডি সংরক্ষণ করেছি, সংগীত কোম্পানিগুলো আমাদের কাছে যেগুলো পাঠায়। বাড়িতে কিছু রাখার মতো আর এক ইঞ্চি জায়গাও বাকি নেই। আমার নাতি-ভাতিজা ও নাতনি-ভাতিজিরা আমার সংগ্রহশালাটি ডিজিটাইজ করতে পারে। আমি অবশ্য ওদের কিছু বলিনি।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনি ঠিক কী নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হন?

লতা: ওহ্, একেবারে ছোটখাটো জিনিস নিয়ে, যার ফলাফল তেমন কিছুই না।

প্রশ্ন :

খালিদ: ১৯৭০-এর দশকে লতা মঙ্গেশকরের একচেটিয়া প্রভাব নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল। বিষয়টি আপনার জন্য বেদনাদায়ক ছিল?

লতা: আমি সহজে আহত হই না। দেখুন, এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট বিচক্ষণতা আছে যে একটি ইন্ডাস্ট্রি—যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র তৈরি করে—তার সবগুলো গান আমাকে দেওয়া উচিত বলে বোধ হয় আমি জবরদস্তি করতে পারি না।

প্রশ্ন :

খালিদ: দশক ধরে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে আশা ভোসলের অনুচ্চারিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে হরদম কথাবার্তা চলেছে।

লতা: দেখুন, কিছু লোক তাঁদের মজ্জাগতভাবেই বিতর্ক উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, লতা অমুক-অমুক গান আশার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। অথবা তার উল্টো। ঘটনা হলো, আমি ক্যাবারে গানগুলো না করে দিতাম। ওগুলো স্বাভাবিকভাবেই আশার কাছে চলে যেত।

কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকর
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনি কি কখনো রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছেন?

লতা: কক্ষনো না। রাজনীতিতে আমার সুদূর আগ্রহও নেই। ১৯৯৯ সাল থেকে আমি ছয় বছর রাজ্যসভার সদস্য ছিলাম, কিন্তু একটি কথাও বলিনি। আমি চুপ করে ছিলাম। রাজনীতির সঙ্গে সংগীতের দূরত্ব ঠিক ততটাই, যতটা আসমানের সঙ্গে জমিনের দূরত্ব। সংগীত আসে একটি কোমল হৃদয় থেকে। রাজনীতির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার প্রয়োজন হয়।

আমাকে প্রায়ই নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে বলা হয়েছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছি। রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার সম্মান গ্রহণ করাটা আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয় ছিল না। অবিরাম বাক্যালাপের পর আমার পক্ষে আর প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হয়নি।

রাজ্যসভার অধিবেশনে অনিয়মিত আর নিশ্চুপ থাকার জন্য অভিনেত্রী শাবানা আজমি আমার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আমি তাঁর সমালোচনার জবাব দিইনি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর, আমারটা আমার। তাই এখনো শাবানা আর আমার দেখা হলে আমরা খুবই আন্তরিক থাকি।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনি সংসদের কার্যধারায় কি বিমোহিত ছিলেন?

লতা: আমি গোবেচারা মুখ করে বসে থাকতাম। বিতর্ক ও আলোচনা, মতামত ও বিপরীত মতামতকে সম্মান জানানো উচিত।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনি টুইটার বেছে নিয়েছিলেন। আপনার কি ট্রলের ঝুঁকি নেই?

লতা: আমি বেশ সতর্ক। আমি এমন কোনো বিষয়ে বলি না, যা আমার জানাবোঝার বাইরে। আমি যা করি, তা হলো জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানো। বড়ে গুলাম আলী খানের মতো মানুষের মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণ করি।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনার কি কোনো শত্রু আছে?

লতা: মানে?

প্রশ্ন :

খালিদ: যাঁরা আপনার প্রতি ক্ষুব্ধ?

লতা: আমি নিশ্চিত, কেউ কেউ নিশ্চয়ই আছে। তবে প্রকাশ্যে কেউ নয়। হয়তো তারা তাদের ক্ষোভের পেছনে যুক্তি দিতে পারে না।

প্রশ্ন :

খালিদ: কে আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু?

লতা: রচনা শাহ, আমার ভাইঝি, মীনার মেয়ে। আমি তাকে আমার বন্ধু, আমার বিশ্বস্তজন মনে করি।

লতা মঙ্গেশকর (ডানে) ও আশা ভোসলে
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনার বিবেচনায় কোনটি আপনার সবচেয়ে আন্ডাররেটেড গান?

লতা: আপনি সম্ভবত বলতে চাইছেন কোনো গান যতটা জনপ্রিয় হতে পারত, ততটা হতে পারেনি। বেশ কয়েকটা গান। আমি মায়া মেমসাব–এর (১৯৯৩) জন্য হৃদয়নাথের সুর করা ‘এক হাসিনা নিগাহ কা’ গানটার কথা বলব। গানটার দুটি সংস্করণ ছিল। একটি কুমার সানুর, আরেকটা আমার। হৃদয়নাথের কম্পোজিশনগুলো প্রায় লেকিন (১৯৯০) সিনেমার গানের মতোই বেশ জটিল। ‘ইয়ারা সিলি সিলি’ জনপ্রিয় হয়েছে, অথচ একই ছবির ‘সুনিয়ো জি আরজ মারিয়ো’ও কার্যকর করা একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনি অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কখনো কি একাকী বোধ করেন?

লতা: আমার মা আমাকে বিয়ে করার জন্য খালি জ্বালাতন করতেন। অবশেষে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমার পরিবার মানে বিয়ের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। মাঝেমধ্যে একাকী বোধ না করলে আমি মানুষ হতে পারতাম না। বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত, আমরা সবাই একাকিত্বে ভুগি। একা থাকা ক্ষতিকর হতে পারে। ভাগ্যক্রমে আমি প্রিয়জনেরা সব সময় আমাকে ঘিরে রাখে।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনি কি কখনো প্রেমে পড়েছেন?

লতা: শুধু আমার কাজের সঙ্গে। আমি আমার একান্ত আপনজন, আমার পরিবারকে ভালোবাসি। এ ছাড়া আর কিছুকে নয়, কাউকে নয়।

প্রশ্ন :

খালিদ: আপনাকে একটি ইচ্ছা করতে বলা হলে আপনি কী চাইবেন?

লতা: আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি। তবু একবার চলে গেলে আমি সত্যিই আবার জন্ম নিতে চাই না। স্রষ্টা আমাকে পুনর্জন্ম না দিলেই ভালো। একটি জীবনই যথেষ্ট।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সাইফুল সামিন