যে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠ আমার মতো কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, নিশ্চয়ই এখন তিনি যেখানে আছেন, শান্তিতেই আছেন।
লতাজির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তটি এখনো আমার কাছে জ্বলজ্বলে।
১৯৭৪ সালের নভেম্বরে ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার ফর রিলেশনস আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আমন্ত্রণে আমি ভারতে যাই। সেখানে তিনটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। প্রথম অনুষ্ঠান ছিল দিল্লিতে, দ্বিতীয়টি মুম্বাইয়ে, আর শেষটা কলকাতায়। সে সময় আয়োজকেরা আমার কাছে জানতে চান, এমন কেউ কি এখানে আছেন, যাঁর সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই? কারও প্রতি কি বিশেষ আগ্রহ আছে আমার? যদি থাকে, তবে সেটা তাঁদের বললে তাঁরা ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি বললাম, আমার একটা প্রত্যাশা আছে। কোনোভাবে কি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দেখা করা যায়? তাঁরা জানালেন, ‘তিনি তো কোথাও যান না। তা ছাড়া তিনি খুবই চুজি। তবু আমরা চেষ্টা করব।’ তাঁদের কথা শুনে ধরেই নিয়েছিলাম, দেখা হবে না।
মুম্বাইয়ের শানমুখানন্দ হলের ব্যাক স্টেজে মহড়া করছিলাম। আমার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন খ্যাতনামা সংগীত পরিচালক দেবুদা, দেবু ভট্টাচার্য। তিনি কি–বোর্ড বাজাচ্ছিলেন আর পুরো সংগীত ব্যবস্থাপনাটা দেখছিলেন। তিনি ছাড়া স্থানীয় সংগীতজ্ঞরাও ছিলেন। অবাক করা একটা ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ দেখি, ব্যাক স্টেজের দরজা দিয়ে কয়েকজন ভদ্রমহিলা ঢুকলেন। এর মধ্যে একজন সাদা শাড়ি পরা। তিনি আমার দিকে আসছেন। তাঁকে দেখে লতাজি লতাজি মনে হচ্ছিল। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? তিনি কেন ব্যাক স্টেজ দিয়ে ঢুকবেন? এরপর দেখি লাল গোলাপ হাতে সত্যি সত্যি লতাজিই আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।
সঙ্গে সঙ্গে আমি গিয়ে তাঁকে সালাম করলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ফুল দিলেন। এর মধ্যে সাংবাদিকেরা খবর পেয়ে গেছেন। তাঁরা এসে ছবি তুললেন। পরদিন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল, ‘ওয়ান নাইটিঙ্গেল মিটস অ্যানাদার’। আমরা সেদিন অনেকক্ষণ বসে কথা বলেছিলাম।
আমি লতাজিকে বললাম, ‘আপনি তো আমার গান কখনো শোনেননি বোধ হয়।’ তিনি বললেন, ‘আমি আপনার গান অনেক শুনেছি। পাকিস্তান রেডিওতে আপনার গান বাজানো হয়। আমরা নিয়মিত আপনার গান শুনি। আপনি এসেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। শুনে নিজেই চলে এসেছি।’ এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া ছিল। লতাজির সঙ্গে সেটাই আমার প্রথম দেখা।
বছরের পর বছর ধরে আমরা ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধার একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম। সর্বোপরি আমরা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায়ই আমাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে এসএমএস (খুদে বার্তা) বিনিময় হতো। মাঝেমধ্যে আমাদের দীর্ঘ টেলিকথোপকথনের বিষয় ছিল সংগীতকে ঘিরেই। এর বাইরে মাঝেমধ্যে তাঁর অনুমতি নিয়েই সাহস করে আমি তাঁকে খুদে বার্তায় মজার মজার কৌতুক পাঠাতাম। তিনি সেই সেসব খুবই উপভোগ করতেন।
দিদির রসবোধ ছিল প্রবল। তাঁর কিছু অভিজ্ঞতাও আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করতেন। শুনে আমার খুবই ভালো লাগত। তাঁর কিন্নরকণ্ঠ আমার কানে সব সময় সংগীতের মতোই মনে হতো।
কখনো কখনো খুদে বার্তায় তাঁকে ‘শুভ সকাল’ জানালে উত্তরে তিনি আমাকে তাঁর পছন্দের জিনিসগুলোর ছবি, ফুল, শিশুদের ছবি পাঠাতেন। কখনো কখনো তাঁর গানের অডিও ও ভিডিও পাঠাতেন, শুনে শুনে যার বেশির ভাগ তত দিনে আমার শেখাও হয়ে গেছে। এগুলো আমার জন্য ছিল তাঁর কাছ থেকে পাওয়া একটি অতিরিক্ত বোনাস।
প্রতিবছর আমার জন্মদিনে তিনি আমাকে একটা শাড়ি পাঠাতেন। এ বছর আমাকে বললেন, ‘আপনি তো লন্ডন যাচ্ছেন। ঢাকায় ফিরে গেলেই আমি আপনার উপহার পাঠিয়ে দেব।’
লন্ডনে আসার ঠিক আগে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা হলো। আমাকে বললেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে তিনি ভীষণ পছন্দ করেন। আমাকে তাঁর পরিবারের খুব কাছের একজন সদস্য বলেই মনে করেন। বলেছিলেন, আমি তাঁর ছোট বোন। আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আমার প্রতিভাকে সম্মান করেন।
কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন যে, আমাকে ভীষণ মিস করছেন। শিগগিরই যেন তাঁকে দেখতে যাই। বলেছিলাম, করোনার এই বৈশ্বিক বিপর্যয় কাটলেই আমি তাঁকে দেখতে যাব। কিন্তু তা তো আর হলো না। আমি হঠাৎ গভীর এক নির্জনতা আর শূন্যতার মধ্যে ডুবে গেছি। কিন্তু তাঁর সব স্মৃতিই আমার সঙ্গে চিরকাল থাকবে। আর কোনো দিন শুনতে পাব না সেই কিন্নরকণ্ঠ, ‘রুনাজি, আপনি কেমন আছেন?’
দিদি, আপনি আমাকেসহ অগণিত মানুষকে বহু কিছুই দিয়েছেন। তবে অনেকের চেয়ে আপনি আমাকে বেশিই দিয়েছেন। এ জন্য আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
আপনি আমাকে আপনার শেষ খুদে বার্তাগুলোতে যে আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন, তার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আমি আপনার আশীর্বাদ আর ভালোবাসা শেষ অবধি লালন করব।