সুইজারল্যান্ডের চাষের জমিতে গরু চরানো। রোদের তেমন বাড়াবাড়ি নেই। যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজ। কোনো মানুষের টিকিটিও চোখে পড়ে না। এরই মধ্যে সব নীরবতা ভেদ করে মাঠের এক প্রান্ত থেকে ছুটে এলেন একজন। পরনে তাঁর শিফনের শাড়ি। আঁচল উড়িয়ে ভিনদেশি মাটিতে একেবারে খাঁটি উপমহাদেশীয় ঢঙে জড়িয়ে ধরলেন প্রিয় মানুষটিকে। এমন দৃশ্যকে ক্যামেরায় বন্দী করার চেষ্টা যশ চোপড়া ছাড়া আর কেউ করতে পারেননি। তাঁর পদরেখা অনুসরণ করে এখনকার পরিচালকেরা সুইজারল্যান্ডের চাষের জমিতে কিংবা শিফন শাড়িতে জড়ানো নায়িকাকে নিয়ে তাক লাগাতে চাইলেও, কেউ কখনোই যশ চোপড়াকে ছুঁয়ে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখাননি।
হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এত দিনে মনে পড়ল যশ চোপড়ার কথা? তাঁর জন্মদিন তো গত ২১ অক্টোবরই পেরিয়ে গেছে। এখন কেন হঠাৎ তাঁকে স্মরণ? না, দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে স্মরণ করা হচ্ছে না। আজ হঠাৎ তাঁকে মনে করার উপযুক্ত উপলক্ষ রয়েছে। কাল ৩০ অক্টোবর যশ চোপড়ার অন্যতম সেরা সৃষ্টি দিল তো পাগল হ্যায় ছবির বয়স ১৮ হবে। পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্ক যাকে বলে! ১৯৯৭ সালের ৩০ অক্টোবর মুক্তি পেয়েছিল যশ চোপড়া পরিচালিত, মাধুরী দীক্ষিত-শাহরুখ খান-কারিশমা কাপুর অভিনীত এই ছবিটি; যা ছিল ওই বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবিগুলোর একটি।
নানা কারণে যশ চোপড়ার দিল তো পাগল হ্যায় এখনো বলিউড ইতিহাসের সেরা ছবিগুলোর একটি হয়ে আছে। নির্মাতা যশ চোপড়া যেভাবে এই ছবির মধ্য দিয়ে আধুনিকতাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন, তা ছিল ৬৫ (১৯৯৭ সালে যশ চোপড়ার বয়স) বছরের কোনো ‘বুড়ো’ পরিচালকের জন্য বেশ সাহসী কাজ। সেই সময়ে দেওয়া চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের দিল তো পাগল হ্যায় ছবির সমালোচনা দেখলে বোঝা যায়, যশ চোপড়া তাঁর কৌশলী নির্মাণশৈলী দিয়ে ঠিকই তরুণদের অনুভূতিকে ধরতে পেরেছিলেন। পর্দায় তুলে ধরেছিলেন কোনো খলচরিত্র কিংবা মারকুটে দৃশ্য ছাড়া একটি পরিচ্ছন্ন প্রেমকাহিনি। এই ছবি নিয়ে সে সময় লেখা হয়েছিল ব্রিটিশ সাময়িকী এম্পায়ার-এ। সেখানে বলা হয়, ‘একেবারে রংধনুর রং দিয়ে নির্মাতা যেন ৩৫ মিলিমিটারের ক্যানভাসে এঁকেছেন উন্নতির দিকে এগিয়ে চলা ভারতীয় সিনেমার নতুন রূপ।’
যশ চোপড়া তাঁর এই আধুনিক প্রেমকাহিনিতে দেখিয়েছিলেন আরও কিছু নতুন ধারণার আবির্ভাব। যেমন ভ্যালেন্টাইন ডে কিংবা ভালোবাসা দিবস পালন। সেই বছর থেকে শুধু ভারতেই না, ভ্যালেন্টাইন ডে পালন যেন এ দেশে হয়ে ওঠে আরও জনপ্রিয়। তা ছাড়া শিফন শাড়ির বদলে মাধুরীর শিফনের সালোয়ার-কামিজও হয়ে ওঠে ওই সময়ের ফ্যাশনধারার জরুরি অংশ। মোদ্দা কথা ১৮ বছর আগের এই ছবির মধ্য দিয়ে যশ চোপড়া শুধু ইতিহাসই গড়েননি, গড়েছিলেন নতুন ভাবনা, নতুন দর্শকমহল আর ভেঙেছিলেন ‘স্টেরিওটাইপ’ প্রেমকাহিনির ধারা। নাচ আর গানে ভরপুর হলেও, ছবির গল্প আর বার্তা কোনোভাবেই সেসবের নিচে চাপা পড়েনি। বরং পশ্চিমা আদলে নয়, উপমহাদেশীয় ঢঙেই তৈরি করেছিলেন এ তল্লাটের নিজস্ব ‘মিউজিক্যাল’ ঘরানার ছবি।
কিছু মজার তথ্য
*দিল তো পাগল হ্যায় ছিল নৃত্যপরিচালক শ্যামক দাভারের প্রথম চলচ্চিত্র। প্রথম ছবি দিয়ে এই শিল্পী জিতে নেন সেরা নৃত্য পরিচালক হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
*ওই বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন কারিশমা কাপুরও, সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, কারিশমার এই ছবিতে কাজ করার কোনো কথাই ছিল না। কারিশমা ছিলেন পরিচালক যশ চোপড়ার নির্বাচিত ষষ্ঠ নায়িকা। এর আগে এই চরিত্রের জন্য তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাভিনা ট্যান্ডন, জুহি চাওলা, কাজল, মনীষা কৈরালা আর শিল্পা শেঠিকে। সবাই ফিরিয়ে দেওয়ার পর কারিশমার কাছে যান যশ চোপড়া।
*দিল তো পাগল হ্যায় ছবির সংগীত পরিচালক উত্তম সিংয়ের এককভাবে করা প্রথম চলচ্চিত্র ছিল এটি। প্রায় দুই বছর সময় নিয়ে তৈরি করেছিলেন এই ছবির গানগুলো। ছবির ‘আরে রে আরে’ গানের শিষ দেওয়া টিউনটি তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশি খাটতে হয়েছিল। এই ছবি তৈরির নেপথ্যের গল্পগুলো নিয়ে তৈরি এক তথ্যচিত্রে উত্তম সিং বলেন, ‘আরে রে আরে’ গানটির জন্য তিনি ১৫০টি টিউন তৈরি করেছিলেন।
*প্রথমে এই ছবির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মোহাব্বত কর লি’।
*ছবিতে মাধুরীর নৃত্যগুরুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অরুণা ইরানি। কিন্তু যশ চোপড়া এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথমে প্রস্তাব দেন হেমা মালিনীকে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেইস, এম্পায়ার ম্যাগাজিন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অবলম্বনে