বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ও একটি ছোটগল্প

শেষ হলো ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব-২০১৩’। নানা আয়োজনে, গুণীশিল্পীদের সুরের বর্ণিলতায় উৎসবটি শেষাবধি যেন হয়ে উঠেছিল ছোটগল্পই। সবকিছু সাঙ্গহলো, কিন্তু শেষ হয়েও যেন হলো না শেষ—রেশ রয়ে গেল...
শেষ অবধি এটা একটা ছোটগল্পই হলো! ছোটগল্পে যেমন শেষের পরেও অনিঃশেষ কিছু থাকে, তেমনি স্কয়ার নিবেদিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’-এর শেষ দিনের লগ্ন যখন শেষ, বেগম পারভীন সুলতানা গাইছেন, ‘হামে তুমসে পিয়ার কিতনা ইয়ে হাম নাহি জানতে...’, গানের গহিনে লেগে থাকা ভালোবাসার সেই তানও বিস্তার পাচ্ছে অনিঃশেষের দিকে। চতুর্থ দিন শেষ রাতে উপস্থিত হাজার হাজার শ্রোতার কণ্ঠে আফসোসের তীব্র সুর, ‘আহা, এখনই শেষ হয়ে যাবে!’ আর সবার অগোচরে সেই মুহূর্তেই লেখা হয়ে গেছে চমৎকার এক ছোটগল্প!

গল্পের শুরু গত ২৮ নভেম্বর, সমাপ্তি ১ ডিসেম্বর। একটানা চার দিন ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে অজস্র গল্পের মধ্য দিয়ে একটি গল্পেরই জন্ম হয়েছে। যদিও দেশজুড়ে এখন সহিংসতা—২৯ নভেম্বর থেকে চলছিল অবরোধ। তবু সন্ধ্যা ঘনাতেই সুরের টানে প্রতিদিনই গৃহী মানুষেরা ছুটে গেছেন উৎসবস্থলে। না, হরতাল-অবরোধে যেসব মানুষ ঘর থেকে বের হন না ভয়ে, ভয়হীন চিত্তে তাঁরাই এসেছিলেন এখানে—সবার মুখাবয়বে কেমন এক প্রশান্তির আভাস। আমাদের প্রশান্তিমুখর ছোটগল্পে এসব রয়েছে অলংকার হয়ে।

উৎসবের তৃতীয় রাতের শেষ পর্বে প্রায় ৩২ হাজার শ্রোতার মুখোমুখি পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া বাঁশিতে তুলেছেন রাগ প্রভাতেশ্বরের লহরি। সেই লহরিতে ভেসে ভেসে উৎসব মঞ্চের সামনে তখন রাতের নিস্তব্ধতা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই—কেবল কোনো কোনো বিমুগ্ধ শ্রোতার মুখ থেকে আনমনেই বেরিয়ে আসছে কিছু প্রশংসাসূচক শব্দ।
এই শব্দগুলো যদি হয় সমঝদারির চিহ্ন, তবে সেই চিহ্ন লেগে ছিল উৎসবজুড়েই। যেমন রাহুল শর্মার সন্তুরের আবহে মুখে হাত দিয়ে অপলক চোখে চেয়ে আছেন হাল ফ্যাশনের পোশাক পরা চুল-ঝাঁকড়া কোনো তরুণী—উৎসবে তৈরি হয়েছে এমন অজস্র ছবি। সেই সব ছবিতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মুখচ্ছবি যেমন ধরা পড়ে, তেমনই লেখা থাকে ময়মনসিংহ থেকে আসা পান-দোকানি মনোয়ার আলীর মুখ, পাতলা একটি চাদর গায়ে জড়িয়েও যাঁর মুখে ছিল শান্তির সুবাস। কেননা, উৎসবের সব শিল্পীর পরিবেশনাই ছিল মুগ্ধতা জাগানিয়া।
অন্যদিকে, উৎসব প্রাঙ্গণে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ আয়েত আলী খান, পণ্ডিত উদয়শঙ্কর ও রবিশঙ্করসহ বরেণ্য শিল্পীদের ডিসপ্লেটিও যেন ছিল সিন্ধুর এক বিন্দু—চার দিনের এই গোটা ছোটগল্পের শরীরে এটি যেন এনে দিয়েছিল আল্পনার উদ্ভাস।
এবারের উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছিল জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে। উৎসবে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ব্র্যাক ব্যাংক, ডেইলি স্টার ও মাছরাঙা টেলিভিশন। সংগীত, বাদন ও নৃত্যের ঝংকারে শ্রোতাদের মাতোয়ারা করেছেন পঞ্চাশের বেশি শিল্পী। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে এমন একটি পর্বও ছিল না, যেটি শ্রোতাদের মন স্পর্শ করেনি। বারবার মুগ্ধতার কথা বলেছেন শিল্পীরাও। গল্পের এ পর্যায়ে ওস্তাদ রশীদ খানের বলা কথাই আবার জানাই না কেন, ‘উচ্চাঙ্গসংগীতের এত বড় অনুষ্ঠান, নির্বাচিত শিল্পীদের পরিবেশনা এবং এত সুশৃঙ্খল আয়োজন আমি আর কোথাও দেখিনি। উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি এ দেশের তরুণদের আগ্রহ ও টান দেখে আমি মুগ্ধ!’—কথাগুলো যখন তিনি বললেন, মনে হলো আরও ঢের মুগ্ধতার আভা তখনো জমা আছে এই গুণী শিল্পীর মনের গোপনে, হয়তো জমাট বেঁধে আছে আরেকটি ছোটগল্পও।