প্রায়ই টিভির ভেতর ঢুকে পড়তে চাইত সে। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হতো ভেতরের লোকগুলোকে। ওদের দেখাদেখি কত যে নেচেছে শিশু অনন্যা, তার ঠিক নেই। শৈশবের সেসব কথা মনে থাকে কারও? বড়রা মনে করিয়ে দিলে হাসি পায়! অনন্যাকে এসব কথা মনে করিয়ে দিতেন মা সুজাতা রহমান।
সেদিন অনন্যা ওয়াফি রহমানের ছবি তোলা চলছিল প্রথম আলোর স্টুডিওতে। তাঁর অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বাজছিল কৌশিকী চক্রবর্তীর কণ্ঠে ঠুমরি। সেটার তালে আপন মনে চক্কর দিচ্ছিলেন তিনি, যেন সামনে অনেক দর্শক! মুখে মেকআপ, পরনে নাচের পোশাক আর গয়না। আলোকচিত্রী তাঁর নাচের মুদ্রা ও অভিব্যক্তিগুলো ফ্রেমবন্দী করছিলেন। ছবি তোলা শেষে গল্প বলেন তিনি। কীভাবে একটি বছর শুধু ‘অভিব্যক্তি’র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ড. উমা শর্মার কাছে। বৃত্তি নিয়ে দিল্লিতে পাঁচ বছর ধৈর্য ধরে করেছেন নাচের ওপর ডিপ্লোমা—পোস্ট ডিপ্লোমা। এখন ব্যস্ত আছেন শিক্ষকতা ও নিজের পরিবেশনা নিয়ে।
সে এক অন্য অনন্যা। চার বছরের শিশু অনন্যাকে নিতেই চায়নি বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা)। পরে নৃত্যগুরু রাহিজা খানম বলেছিলেন, ছোট, তাতে কী? শিখুক। শেখার ফল দিয়েছিল ছোট্ট অনন্যা। একদিন সত্যি সত্যি টিভির ভেতর ঢুকে পড়ল সে। ১৯৮৯ সালে বিটিভির নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় সাধারণ নৃত্যে হলেন প্রথম, আর কত্থকে তৃতীয়। বিচারক শিবলী মোহাম্মদ সেদিন বলেছিলেন, মন দিয়ে শিখলে কত্থকে ভালো করবে অনন্যা। পণ্ডিত বিরজু মহারাজের এই শিষ্যই পরে হলেন অনন্যার কত্থকগুরু। তাঁর কাছেই শুরু। উচ্চমাধ্যমিকের পর আইসিসিআরের বৃত্তি নিয়ে শিখতে চলে যান দিল্লিতে।
লক্ষ্ণৌ ঘরানার শিল্পী অনন্যা। নম্র আর লাস্যময় সেই ঘরানা। তাঁর চোখজুড়ানো নাচ দেখেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের অতিথি আর কামানিয়া মিলনায়তনের দর্শকেরা। এসব জায়গায় নাচ করা কম সম্মানের নয়। দেশে তাঁর নৃত্যনাট্য সবুজ নারী সাড়া ফেলেছিল। মঞ্চে মৃচ্ছকটিক নাটকে প্রধান চরিত্র করার জন্য লেগে থাকতে হয়েছিল দুই বছর। তবে পরিবেশনার থেকে বেশি সময় গেছে শেখানোয়। নতুন করে বোধোদয় হয়েছে—আবার মঞ্চে ফিরতে হবে। শাস্ত্রীয় পরিষদ, শুদ্ধসংগীত প্রচারগোষ্ঠীর মতো সংস্থাগুলোর সঙ্গে অনন্যার নিজের দল ‘নৃত্যমঞ্চ’ অনুষ্ঠান করছে।
একজন নৃত্যশিল্পীর প্রত্যাশা কী? টিভিতে নাচ করা? ১৫ থেকে ৬০ ইঞ্চি যার পর্দার দৈর্ঘ্য? শিল্পী বললেন, ‘না, আরও কিছু বেশি। টিভির পর্দায় শাস্ত্রীয় নৃত্য দেখে ভালো নাচের দর্শকের মন ভরে না। তাঁর দরকার বিরাট মঞ্চ। শিল্পীর চাই চোখের সামনে শত শত, হাজার হাজার দর্শক। মঞ্চে ঢুকে তিনি দর্শকদের সঙ্গে চোখে-চোখে সংযোগ করবেন। এই যোগাযোগ ছাড়া পারফরম্যান্সের আনন্দ কোথায়? তবে দর্শকের মানসিকতা উন্নত করতে হবে। শাস্ত্রীয় নৃত্যের মতো উচ্চাঙ্গের বিনোদনের পেছনে অর্থ ব্যয় করা শিখতে হবে। শুধু ফুটবল-ক্রিকেট আর সিনেমার টিকিট দাম দিয়ে কিনলেই চলবে না।