আবেগ, অনুভূতি আর পুরস্কারের ২৮ বছর

জনপ্রিয় হয়েছিল আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠীর সব পরিবেশনা
জনপ্রিয় হয়েছিল আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠীর সব পরিবেশনা

১২ অক্টোবরে সত্তরে পা রাখছেন তিনি। তার একদিন আগে ১১ অক্টোবর ২৮ বছরে পা রাখছে তাঁর হাতে গড়া সংগঠন ‘আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠী’। আশির দশকে রাজধানীর বাইরে মফস্বল শহর বগুড়ায় সৃজনশীল ও শৈল্পিক লোকনৃত্য দিয়ে শুরু করেছিলেন আবদুস সামাদ। এলাকার মানুষ অবশ্য তাঁকে পলাশ নামেই চেনেন। আর নাচ নিয়ে মেতে থাকার কারণেই পেয়েছেন ‘নৃত্যগুরু’ খেতাব। কিন্তু এই প্রাপ্তি কিংবা এই ২৮ বছর পার করতে পাড়ি দিতে হয়েছে একটা দীর্ঘ পথ। দারিদ্র্যের বিপরীতে চলতে গিয়ে তাঁকে কখনো হতে হয়েছে পত্রিকার হকার, নেচেছেন যাত্রায়, স্বল্প বেতনে চাকরি করেছেন গণগ্রন্থাগারে। কিন্তু অন্তরে যাঁর নাচ, তাঁকে কোনো বাধাই আটকে রাখতে পারে না—এই কথার জ্বলন্ত উদাহরণ হতে পারেন আবদুস সামাদ। শুরু করেছিলেন পাড়ায়-মহল্লায় মঞ্চে নৃত্যনৈপুণ্য দেখে দেখে। সেটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে ঢাকায় গিয়ে নৃত্যগুরুদের কাছে নাচ শেখার মাধ্যমে।

কয়েক দিন আগে বগুড়ার শহীদ টিটু মিলনায়তনের মহড়া কক্ষে আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠীর নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা’র নির্দেশনাকালে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বর্ণাঢ্য শিল্পীজীবনের কথা বলতে গিয়ে ফিরে যান ৬০ বছর পেছনের স্মৃতিতে। বলেন তাঁর হাতে গড়া ‘আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠী’ নিয়ে।

‘শৈশবে বাবাকে হারিয়েছি। কয়েক বছর কাটিয়েছি পথশিশুদের সঙ্গে। সকালে পত্রিকার হকারি করতাম। সারা দিনে যা রোজগার হতো, তা দিয়ে রাতে নৈশ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ যোগাতাম। ১০ বছর বয়সে বগুড়া শহরের একটা গণগ্রন্থাগারে বই গোছানোর চাকরি নিয়েছিলাম। আর রাতে মহল্লায় নানা অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। শিল্পীদের নাচের মুদ্রা দেখে তা রপ্ত করার চেষ্টা করেছি। বাড়িতে ফিরে একা একা সেই মুদ্রা চেষ্টা করতাম।’ বলছিলেন আবদুস সামাদ।

আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুস সামাদ
আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুস সামাদ


তাঁর হাত ধরে ১৯৮৮ সালের ১১ নভেম্বর বগুড়ার উডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে একক নৃত্যসন্ধ্যার মধ্য দিয়ে আমরা কজন শিল্পী গোষ্ঠীর পথচলা শুরু হয়। নৃত্যের পাশাপাশি অভিনয়, সংগীত ও আবৃত্তি চর্চাতেও সমান দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হন সংগঠনের শিল্পীরা। বগুড়ার মঞ্চে নিয়মিত নৃত্য উৎসব আয়োজন ছাড়াও প্রতিবছর দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের কথাসাহিত্যিক ‘রোমেনা আফাজ পদক’ প্রদান করছে সংগঠনটি। আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠীর নৃত্যশিল্পীরা চীন, জাপান, দুবাই, ভারত (দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা), শ্রীলঙ্কা, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নৃত্য নিয়ে ঘুরে এসেছেন।
স্বীকৃতির পাল্লাটাও ভারী কম নয়। ২০১১ সালের নৃত্য উৎসবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সম্মাননা, ২০১২ সালে বিভাগীয় কমিশনার সম্মাননা ও ২০১৪ সালে বিশ্ব নৃত্য দিবসে বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংস্থার সম্মাননা পেয়েছে সংগঠনটি। দেশের বাইরে ভারতেও সম্মাননা মিলেছে একাধিক।
ব্যক্তিগতভাবে আবদুস সামাদও পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননা। ২০১২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় নৃত্য শিল্পী সংস্থা থেকে পেয়েছেন ‘ওস্তাদ গওহর জামিল পদক’। ২০১৪ সালে পেয়েছেন ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক’। দেশের বাইরে ২০১১ সালে ভারতের রবীন্দ্র সদনে বাংলাদেশের লোকনৃত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তড়িৎ সরকার ‘ব্যালেট্রুপ পদক’ এবং ২০১২ সালে কলকাতার ‘কথা প্রসঙ্গ নাট্যদল সম্মাননা’ পেয়েছেন তিনি।
আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠীর দর্শকনন্দিত নৃত্যনাট্যের মধ্যে ছিল নাগ পূর্ণিমা, লাইলী মজনু, নানা বর্ণে বাংলাদেশ, একাত্তরের কথা,ঞ্চকন্যা, চণ্ডালিকা, বৃদ্ধাশ্রম, ইছামতীর বাঁকে,হুয়া, বারামখানা চিত্রাঙ্গদা। এর মধ্যে ঢাকার সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা অপু বিশ্বাস লাইলী মজনু এবং নাগ পূর্ণিমা নৃত্যনাট্যের মূল চরিত্রে মঞ্চ মাতিয়ে তারকাখ্যাতি পান।

শুধু অপু বিশ্বাসই নন। ২০০৯ সালে রিয়েলিটি শো মার্কস অলরাউন্ডে সেরা ফারিয়া রথি, ২০১২ সালে চ্যানেল আই সেরা নাচিয়ের চ্যাম্পিয়ন মোহনা মীম, ২০১৪ সালের ইমামি ফেয়ার হ্যান্ডসাম দ্য আলটিমেট ম্যান সিজন ট্যুর চ্যাম্পিয়ন আবুল কালাম আজাদ নিজ নিজ অঙ্গনে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন।

এখানেই শেষ নয়, আবদুস সামাদ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বগুড়া শহরে খুলেছেন একটি নৃত্য পাঠশালা। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমরা কজন বিদ্যা পিঠ নামে আরেকটি পাঠশালা খুলব। যেখানে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শুদ্ধ সংস্কৃতির নানা শাখা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’