যেমন করে গাইছে আকাশ...

খালেদ খান ও স্ত্রী মিতা হক
খালেদ খান ও স্ত্রী মিতা হক

‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ...’ গানটি ছিল খালেদ খানের (যুবরাজ) খুব প্রিয়। ২০ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হন। এই অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার, নির্দেশক, সংগীতশিল্পী এবং দক্ষ প্রশাসককে সোমবার সন্ধ্যায় স্মরণ করলেন তাঁর স্ত্রী সংগীতশিল্পী মিতা হক
যুবরাজ নেই, তিন দিন হলো। ওর রুমটার দিকে তাকাতেই পারি না। বিছানা খালি পড়ে আছে। পাশে হুইল চেয়ারটা। সারা দিন বাসায় অনেক মানুষ আসছেন। সবাই যুরবাজের কথা বলছেন। আমি শুধু শুনেছি। এবার আমাকে যুবরাজের কথা বলতে হবে। কোথা থেকে শুরু করব, ভাবছি। শুরুটা সেই শুরু থেকেই হোক।

বিয়েতে সেদিন দুজনে
বিয়েতে সেদিন দুজনে

যুবরাজকে প্রথম দেখেছিলাম আমার দাদির বাসায়। ১৯৮০ সাল। হাতিরপুলে, মোতালেব কলোনিতে। দাদির বাসায় প্রায় নিয়মিতই থাকতেন বড়দা কাকা (ওয়াহিদুল হক)। তাঁর কাছে আসতেন যুবরাজ। দাদি তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
পরের বছর রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের জাতীয় সম্মেলন হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে হচ্ছে বাছাই পর্ব। যুবরাজের সঙ্গে সেখানে দেখা হলো। ও বলল, ‘তুমি মিতু না?’ বাসার সবাই আর খুব পরিচিতজনেরা আমাকে মিতু বলেই ডাকে। সম্মেলনের তৃতীয় দিন বাংলা একাডেমিতে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় অচলায়তন নাটক করে। যুবরাজ এই নাটকে ‘পঞ্চক’ চরিত্রে অভিনয় করত। আমি ওর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
এরপর যুবরাজের উৎসাহেই বড়দা কাকার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাসায় আমরা নিয়মিত গান শিখতে বসতাম। তখন কীভাবে যেন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা বাড়তে লাগল। আমাদের বিয়ে হলো ১৯৮৫ সালের পয়লা জানুয়ারি।
আজ ওর গাওয়া অনেক গান আমার কানে বাজছে—‘আমাকে যে বাঁধবে ধরে’, ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে’, ‘আজ যেমন ক’রে গাইছে আকাশ’, ‘যখন তুমি বাঁধছিলে তার’, ‘আমি কী ব’লে করিব নিবেদন’, ‘যদি এ আমার হূদয়দুয়ার’, ‘আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’, ‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে’...।
আমি ছিলাম ওর অভিনয়ের দারুণ ভক্ত। কবর দিয়ে দাও নাটকে ওর একটা সংলাপ ছিল—‘আমি এই হাতে স্বর্গের চাবি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।’ সংলাপটি শোনার জন্য তখন এই নাটকের একটি প্রদর্শনীও মিস করিনি।
টিভিতে ওর শুরুটা হয়েছিল সকাল সন্ধ্যা দিয়ে। এইসব দিনরাত্রি নাটকের কয়েকটা পর্ব ও করেনি। তখন আমাদের বিয়ে হয়। নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ তখন নাটকে ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। ওর আরেকটা ধারাবাহিক আমার খুব ভালো লাগত, মফস্বল সংবাদ। ও ছিল সাংবাদিক।
যুবরাজ খাবারের ব্যাপারে ভয়ংকর শৌখিন ছিল। প্রায়ই অফিস থেকে ফেরার পথে ও সঙ্গে করে বড় মাছ নিয়ে আসত। এসে বলত, ‘মাছটা একটু রান্না করে দাও না।’ রাতে হয়তো বলে বসল, ‘খিচুড়ি-মাংস খাব।’ ডাল ছাড়া খিচুড়ি! কোন চালে খিচুড়ি খাবে, তাও বলে দিত।
ঈদ এলে ও ছোটদের মতো আচরণ করত। সবার জন্য জামা-কাপড় কিনত। অনেক বাজার করত। না হলেও ১০ পদের রান্না করতে হতো। ও বাড়ির বড় ছেলে। আমাদের বাসায় ওর ভাইবোন সবাই আসত।
জন্মদিনে কেউ ওকে শুভেচ্ছা জানালে কী যে খুশি হতো! খুব রঙিন আর উজ্জ্বল রঙের কাপড় পরত। আর বলত, ‘দেখো, আমাকে পরির মতো লাগছে!’

পারিবারিক আড্ডায়। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
পারিবারিক আড্ডায়। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ চালু হওয়ার দুই বছর আগে থেকে ও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। ও নিজে পড়াত। শেষ পর্যন্ত পড়িয়েছিল ‘থিয়েটার অ্যান্ড কমিউনিকেশন’। অনেক দিন ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ছিল। মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ পায়।
চ্যানেল আইয়ে ১৩ ডিসেম্বর ‘গানে গানে সকাল শুরু’ অনুষ্ঠানে আমি আর জয়িতা গান গেয়েছিলাম। বাসায় ফেরার পর ও বলল, ‘জয়িতার কিন্তু প্রায় খুব ভালো হয়েছে। এই প্রায়টা জয়িতা কবে অতিক্রম করবে।’ আর আমাকে বলল, ‘শোনো, তুমি কিন্তু একটু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলো। তোমার গলাটার মধ্যে যে একটু কষ্ট হচ্ছে, এটা কিন্তু বোঝা যায়। বয়সটাকে হেলা কোরো না।’
১৬ ডিসেম্বর দুপুরবেলা। ও খুব অসুস্থ। আমাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতেই হবে। ও কিছু বলছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? ঘুম পাচ্ছে?’ ও বলল, ‘হ্যাঁ, ধন্যবাদ, বুঝতে যে পারলা।’ এটাই যুবরাজের সঙ্গে আমার শেষ কথা।
যুবরাজকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, ‘যেখানেই আছো, ভালো থেকো, শান্তিতে থেকো।’