চোখ শুধু ইউটিউবে

>

ভিডিও দেখার ওয়েবসাইট ইউটিউব এখন ঘরোয়া বিনোদনের বড় এক মাধ্যম। শিল্পী, প্রযোজকেরা গান, মিউজিক ভিডিও, নাটক প্রকাশের জন্য বেছে নিচ্ছেন ইউটিউব। এসব নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।

জনপ্রিয় মোশাররফ করিমের নাটক
জনপ্রিয় মোশাররফ করিমের নাটক

ভারতে প্রথম আসে গ্রামোফোন। তারপর রেডিওতে সবাই গান শুনত। নাটকও শোনা যেত ওখানেই। ঢাকা ও কলকাতার রেডিওতে প্রচারিত হতো অনুরোধের গান। রেডিও সিলনে (শ্রীলঙ্কার জাতীয় বেতার কেন্দ্র) শোনা যেত বিদেশি গান। তারপর শোনার জায়গায় ধীরে ধীরে আসন গাড়ে ৪৫ আরপিএমের লংপ্লে। এরপর ১৮ ইঞ্চির রেকর্ড। তারপর এসেছে অডিও ক্যাসেট। এখন সময় বদলে গেছে। গান শোনা বা গানের ভিডিও দেখার জন্য ডিভিডি প্লেয়ার, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ কম্পিউটার ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা টেলিভিশন ও স্মার্টফোনকে বেছে নিয়েছেন সবাই। শুধু ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই চলে। ইউটিউবে শুধু একবার ঢুঁ মেরে সবাই নিজের পছন্দের শিল্পীর গান শোনা ও ভিডিও দেখার কাজ করে নিচ্ছেন খুব সহজে।

মিনার
মিনার

ইউটিউবে বদলে গেল সব

২০০০ সালের পর গান শোনার মাধ্যম হিসেবে এল সিডি (কমপ্যাক্ট ডিস্ক)। সিডি–ডিভিডির যুগ এখনো আছে ঠিকই, কিন্তু শিল্পী বা প্রতিষ্ঠান কাউকে সিডি প্রকাশে খুব একটা আগ্রহী হতে দেখা যায় না। শিল্পীরা অনেক বেশি মনোযোগী তাঁদের সৃষ্টিতে। অনেকে তো নিজের ঘরেই বানিয়ে নিয়েছেন স্টুডিও। সেখানে বসে তাঁরা মনের আনন্দে গান তৈরি করছেন। কখনো স্টুডিও ভার্সন ভিডিও বানিয়ে তা ছেড়ে দিচ্ছেন ইউটিউবে আর মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশ ও দেশের বাইরে বাংলা গানের শ্রোতা ও দর্শকদের কাছে। এসব গান দেখা হচ্ছে, শোনা হচ্ছে হাজার, লাখ এমনকি কোটি বারও।

ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ইমরানুল আহসানের গান শোনার অভ্যাস স্কুলজীবন থেকে। একসময় সিডি কিনে গান শুনতেন। এখন গান শোনার জন্য তাঁর একমাত্র ভরসা সঙ্গে থাকা স্মার্টফোন। বললেন, ‘ইউটিউব ছাড়া গান শোনার অন্য যে জায়গাগুলো (আইটিউনস, অ্যামাজনস, স্পটিফাই) আছে, তা চালানো তুলনামূলকভাবে জটিল ও টাকা দিতে হয়। অন্যদিকে ইউটিউবে গান শুনতে ও দেখতে কোনো টাকা লাগে না। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই হয়।’

ইউটিউবে জনপ্রিয় হয়েছে ইমরান ও কণার গান
ইউটিউবে জনপ্রিয় হয়েছে ইমরান ও কণার গান

অপেক্ষা নতুন গানের

শুধু শিল্পীরা নন, সময়ের চাহিদায় গান পৃষ্ঠপোষক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানও তাই নিজেদের ‘আপ টু ডেট’ করে নিয়েছে। তারা সিডি যেমন প্রকাশ করছে, তার চেয়ে কিছুটা বেশি মনোযোগী হয়েছে নিজেদের ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম নিয়ে। সাউন্ডটেক, সংগীতা, লেজার ভিশন, সিডি চয়েজ, ইগল মিউজিক ও সিএমভি থেকে শুরু করে যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে, সবগুলোই তাদের ইউটিউব ও ডিজিটাল অন্যান্য মাধ্যম নিয়ে বেশি ভাবছে।

গান বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান সিএমভির স্বত্বাধিকারী শেখ সাহেদ আলী বলেন, ‘এটা ঠিক, এখন সবাই গান ইউটিউবে শুনছেন ও দেখছেন। আমরাও সেদিকে জোর দিচ্ছি। কিন্তু ইউটিউব থেকে যা আয় হচ্ছে তা কোন প্রক্রিয়ায় আমরা (শিল্পী, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান) পাচ্ছি, সেটি পরিষ্কার নয়। তাই আমরা এখন অ্যাপ্লিকেশনমুখী হতে চাই। আমাদের দেশে জিপি মিউজিক ও রবি ইয়োন্ডার শিল্পী ও প্রতিষ্ঠানবান্ধব। আস্তে আস্তে আমাদেরও ইচ্ছা আছে সবারই নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশন চালু করার।’

প্রযুক্তি অগ্রাহ্য করা যাবে না। এটা সব সময় আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাইলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য শাফিন আহমেদ। বলেন, ‘আমাদের সবাইকে অভ্যস্ত হতে হবে একধাপ এগিয়ে থাকার। ইউটিউব এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, যার সঙ্গে ভিজ্যুয়াল জড়িত।’

আরেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশনের মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘ইউটিউব জনপ্রিয় হওয়ার কারণে আমাদের বিপণন পরিধিও বেড়ে গেছে। এখানে একটা গান প্রকাশের সঙ্গে সারা পৃথিবীর দর্শক-শ্রোতারা মুহূর্তেই তা শুনতে-দেখতে পারছেন। আগে সিডি কিংবা অ্যালবামের বিজ্ঞাপন দিতে হতো, এখন ইউটিউবে বুস্ট (অনলাইন বিজ্ঞাপন) করে তা অধিক মানুষের কাছেও নিয়ে যাওয়া যায়।’

ইউটিউবে যা জনপ্রিয়

এখন পর্যন্ত ইউটিউবে জনপ্রিয় গান সংগীতশিল্পী ইমরানের ‘বলতে বলতে চলতে চলতে’ শিরোনামের গান। বেশ কিছুদিন আগে কোটি ছাড়িয়েছে। গানটির এত জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে ওই শিল্পী বললেন, ‘সুন্দর লোকেশনের ভিডিও এবং গানটির কারণেই সবাই পছন্দ করছেন। আর এখনকার শ্রোতারাও অনলাইননির্ভর। এ কারণেই সবার পছন্দের তালিকায় রয়েছে গানটি।’

কনার বেশ কয়েকটি গান ইউটিউবে বেশ জনপ্রিয়। তিনি বললেন, ‘জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ আসলে গান। ভিডিও একবার-দুবার দেখলে আবেদন ফুরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু গান ভালো হলেই মানুষ বারবার শোনে।’

এক কোটিবার দেখার দ্বারপ্রান্তে আছে মিনারের ‘ঝুম’ গানটি। সাড়ে ৯৯ লাখ পেরিয়েছে বুধবারই। এরই মধ্যে গানটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গানচিল ঘোষণা দিয়েছে, কোটি পার হলেই ঘটা করে আয়োজন করে সেটা উদ্‌যাপন করা হবে।

শুধু গানই নয়, ইউটিউবে মানুষ চোখ রাখে নাটক দেখতেও। বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা ও সময়মতো দেশীয় চ্যানেলে নাটক দেখার সুযোগ না পেলেও এক টানে দেখা যায় ইউটিউবে। এই মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি দেখায় জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম অভিনীত নাটকগুলো। এমনকি মোশাররফ করিম অভিনীত বিভিন্ন নাটকের ছোট ছোট ভিডিও জনপ্রিয় হয়েছে ইউটিউবে। এ ছাড়া ইউটিউবের জন্য নির্মিত হয় নানা ধরনের অনুষ্ঠান। এর মধ্যে বঙ্গবিডি নামে একটি চ্যানেলও নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি চ্যানেল এরই মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে।

স্মার্টফোনে পৃথিবীর গান

ইউটিউবের কথা উল্লেখ করে পুরো ব্যাপারটাকে রূপান্তর মনে করছেন কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী। তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন অনেক ব্যস্ত। তাই তারা গান শোনার জন্য তাদের কাছের সবচেয়ে সহজ মাধ্যমটিকে বেছে নিচ্ছে।’

দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক চালুর পর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইউটিউব ব্যবহারের হার বেড়ে যায়। সামনের সময়ে এই হার আরও দ্রুতগতিতে বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা। এতে করে পুরো পৃথিবীর গান শুনতে চায় তারা।।

ইউটিউবে সেরা ১০ গানের ভিডিও

বেশ কয়েক বছর ধরে ইউটিউবে সংগীতশিল্পীদের গানের ভিডিও মুক্তির হিড়িক পড়েছে। পাশাপাশি সিনেমার গানও। এযাবত্কালে বাংলাদেশ থেকে ইউটিউবে মুক্তি পাওয়া গানের ভিডিও থেকে (বুধবার দুপুর পর্যন্ত) সবচেয়ে বেশিবার দেখা ভিডিওগুলো নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

স্থান  গানের শিরোনাম      শিল্পী    যতবার দেখা হয়েছে

১    বলতে বলতে চলতে    ইমরান   ১ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার

২   ঝুম      মিনার রহমান     ৯৯ লাখ ৮৬ হাজার

৩   তুমি আমার       জনি ও মোহনা    ৯৮ লাখ ৫৭ হাজার

৪   ম্যাজিক মামুনি   নেহা কাক্কর ও স্যাভি (অগ্নি ২)   ৯৩ লাখ ৮৬ হাজার

৫  দিল দিল দিল  ইমরান ও কণা (বসগিরি)    ৯২ লাখ ৯১ হাজার

৬  ফিরে আসো না     ইমরান    ৯১ লাখ ৬৬ হাজার

৭  যে পাখি ঘর বোঝে না    ধ্রুব গুহ       ৮৩ লাখ ২৩ হাজার

৮  রেশমি চুড়ি        কণা      ৮১ লাখ ৮৫ হাজার

৯  পরী কণিকা    কাপুর ও আকাশ (রক্ত)    ৮১ লাখ ৫৬ হাজার

১০  মেয়েদের মন বোঝা  স্যাভি ও কণা (আশিকি)    ৭৯ লাখ ৭২ হাজার