গ্রামোফোন রেকর্ড শিল্পীদের মাস্টারমশাই

রাজশাহীতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গান গাইছেন ৯৮ বছর বয়সী দিলীপ কুমার রায়। পাশে তাঁর ছাত্রী অর্চনা ভৌমিক
রাজশাহীতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গান গাইছেন ৯৮ বছর বয়সী দিলীপ কুমার রায়। পাশে তাঁর ছাত্রী অর্চনা ভৌমিক

সবার শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই দিলীপ কুমার রায় ২৯ এপ্রিল তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ করে ১০১ বছরে পদার্পণ করবেন। এখনো তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করছেন। ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত গান শেখাচ্ছেন। তাঁর জন্মশতবর্ষে আমাদের শ্রদ্ধা

ইকবাল মতিন

‘ইকবাল, আমি কিন্তু মাস্টারমশাই। আমার এখনো হাত চলে। আমার সঙ্গে মশকরা?’ গত ২৮ অক্টোবর, ২০১৪ তারিখে আমার গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রহশালায় বসে কথাগুলো বলেছিলেন কবি রজনীকান্ত সেনের নাতি ’তিরিশ-চল্লিশের দশকের প্রখ্যাত শিল্পী, সুরকার এবং সে সময়কার গ্রামোফোন রেকর্ডের শিল্পীদের মাস্টারমশাই অর্থাৎ রেকর্ড কোম্পানির ভাষায় ট্রেনার ৯৮ বছর বয়সী শ্রদ্ধেয় দিলীপ কুমার রায়। তিনি কলকাতা থেকে রাজশাহীতে এসেছিলেন আমার গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রহশালা এবং তাঁর নানা রজনীকান্ত সেন যে বাসায় থাকতেন, সেটি দেখার জন্য।

আমার সংগ্রহে দিলীপ কুমার রায়ের গাওয়া বেশ কয়েকটি রেকর্ড আছে। আমার মাথায় এক দুষ্টুমি বুদ্ধি এল। ১৯৩৮ সালে তাঁরই গাওয়া প্রথম রেকর্ডটি আমি গ্রামোফোন মেশিনে চাপিয়ে বললাম, ‘কাকু, আপনাকে আমি প্রায় ৭৬-৭৭ বছর আগের একটি রেকর্ড শোনাচ্ছি। যন্ত্রে ৭৮ আরপিএমে বাজতে লাগল ‘কাঁদিছে একেলা কেকা’। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন সেই শিল্পীর গান। কয়েক সেকেন্ড পরেই বুঝলেন যে আমি দুষ্টুমি করে তাঁরই গান তাঁকে শোনাচ্ছি। তখনই তিনি আমার দিকে ঘুষি তুলে ওপরের কথাগুলো বলেছিলেন।

সত্যরঞ্জন রায়ের পাঁচ ছেলের মধ্যে সবচেয়ে বড় দিলীপ কুমার রায় জন্মেছিলেন মামাবাড়ি পাবনার ভাঙ্গাবাড়ীতে। মা শান্তি দেবী রজনীকান্ত সেনের কন্যা। বাবা ছিলেন কেমিস্ট। ১৯৩৯ সালে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে দিলীপ কুমার রায় কিছুদিন চাকরি করার পরে বাবার কেমিকেল ফার্মে যোগ দেন। সেই সঙ্গে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতা চলতে থাকে।

তাঁর সংগীত শিক্ষা কখন কীভাবে শুরু হলো জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই মা, মাসিমা এবং বাড়ির অন্য সবার সঙ্গে গাইতে গাইতে গান শুরু হয়। শ্রীযুক্ত শৈলেন সেন মহাশয়ের কাছে আমার প্রথম গান শেখা শুরু হয়। পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, শচীন দেব বর্মণ, অনুপম ঘটক, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমুখের কাছে সংগীতের প্রকৃত পাঠ পাই। কিন্তু আমি সবচেয়ে যাঁর দ্বারা বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি, তিনি হলেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ রায়।’

দিলীপ কুমার রায়ের প্রথম রেকর্ড
দিলীপ কুমার রায়ের প্রথম রেকর্ড

দিলীপ কুমার রায়ের সম্পর্কে মামা সুকৃতি সেন ছিলেন সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির ট্রেনার। তিনি একদিন দিলীপ কুমার রায়ের গান শুনে ডেকে বললেন, ‘রেকর্ড করবে?’ তখন রেকর্ডের গানের বই ছাপা হতো। দিলীপ রায় চিন্তা করলেন যে রেকর্ডে যদি গান গাইবার সুযোগ পান, তবে অন্য শিল্পীদের পাশে তাঁর নামও সে বইয়ে ছাপা হবে। রাজি হয়ে গেলেন। একদিন মামার সঙ্গে সেনোলা কোম্পানিতে গেলেন অডিশন দিতে। পরীক্ষকেরা গম্ভীরমুখে গান শুনলেন। তাঁর কেন জানি মনে হলো অবস্থা ভালো না। কাজেই তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সেখান থেকে পালালেন। এর মধ্যে বেশ কিছুদিন মামার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। একদিন দেখা হতে মামা বললেন, ‘তুমি সেদিন না বলে সেখান থেকে চলে এলে, ওরা তো তোমাকে সিলেক্ট করেছে।’ এরপর গান রেকর্ডিংয়ের জন্য শুরু হলো রিহার্সাল। প্রথম দুটি গান শিখতে সময় নিয়েছিলেন দুই-আড়াই মাস। রেকর্ড হলো। সুকৃতি সেনের কথা ও সুরে রেকর্ডের দুই পিঠে দুটো গান। ১৯৩৮ সালের পুজোয় রেকর্ডটি বেরোল। অজয় ভট্টাচার্যের কথা ও বীরেন ভট্টাচার্যের সুরে ‘তোমায় আমায় দেখা হবে অশ্রুনদীর তীরে/ আজি গোধূলির বাঁশরী’। দিলীপবাবু গ্রামোফোন কোম্পানিতে যদিও রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ এবং দ্বিজেন্দ্রলালের গানের ট্রেনার ছিলেন, কিন্তু তিনি প্রথম জীবনে আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে বেশ কিছু রেকর্ড করেন। যেমন ‘জানি জানি এ বেদনা মিছে নয়’, ‘গানগুলি মোর ভেসে চলে’; কাজী নজরুল ইসলামের কথায় ও সুরে ‘আমি রচিয়াছি নব ব্রজধাম’ ইত্যাদি। ১৯৩৯ সালে আকাশবানীতে গান গাইলেন প্রথমে আধুনিক, পরে রবীন্দ্রসংগীত। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে হরিপদ রায়ের ট্রেনিংয়ে অতুলপ্রসাদ সেনের ‘তুমি গাও তুমি গাও’/ ‘ওগো দুঃখসুখের সাথি’ গান দুটি সেনোলা থেকে বের হয়। রজনীকান্ত সেনের গানও প্রথম রেকর্ড করেন সেনোলাতে। এই কোম্পানি থেকেই তাঁর শেষ রেকর্ডটি করেন চল্লিশের দশকের শেষের দিকে।

দিলীপবাবুর গাওয়া তাঁর দাদু রজনীকান্ত সেনের গানের প্রথম রেকর্ড ‘বেলা যে ফুরায়ে যায়/ কেউ নয়ন মুদে দেখে আলো’। এরপর দীর্ঘদিন রেকর্ড করেননি। এর মধ্যে পঞ্চাশের দশকে ট্রেনার হিসেবে যুক্ত হন এইচএমভিতে। গায়ত্রী মুখোপাধ্যায় প্রথম অতুলপ্রসাদের গান করলেন দিলীপবাবুর ট্রেনিংয়ে। গান দুটি ‘আর কতকাল থাকব বসে’ এবং ‘বধূয়া, নিদ নাহি আঁখি পাতে’।

২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর দিলীপ কুমার রায় রাজশাহীতে এসে গাড়ি থেকে নেমেই রাজশাহীর মাটিতে চুমু খেলেন। তাঁর শিক্ষাজীবনের প্রথম প্রতিষ্ঠান বি বি হিন্দু একাডেমিতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি ও তাঁর ছাত্রী শ্রীমতি অর্চনা ভৌমিক সংগীত পরিবেশন করেন। পরদিন সকালে তিনি তাঁর দাদু রজনীকান্ত সেনের বাড়ির ভিটার একটু মাটি এবং ভাঙা দেয়ালের একটা ইটের টুকরা নিয়ে গেলেন।

সবার শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই দিলীপ কুমার রায় ২৯ এপ্রিল তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ করে ১০১ বছরে পদার্পণ করবেন। এখনো তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করছেন। ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত গান শেখাচ্ছেন। তাঁর জন্মশতবর্ষে আমাদের শ্রদ্ধা।

লেখক: অধ্যাপক, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সংগীতশিল্পী ও গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রাহক।