সন্ধ্যার ঝলমলে তারারা...

উপস্থাপনার একপর্যায়ে দর্শকদের মাঝে চলে এসেছিলেন ফেরদৌস ও পূর্ণিমা
উপস্থাপনার একপর্যায়ে দর্শকদের মাঝে চলে এসেছিলেন ফেরদৌস ও পূর্ণিমা

দর্শকের আসনে বসা সাঁঝবাতির মন তখন পড়ে আছে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে সে!
দর্শকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে তখন ফেরদৌস আর পূর্ণিমা। তাঁদের উপস্থাপনার গুণে সৃষ্টি হয়েছে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার মতো পরিবেশ। একে একে পালা এল সেরা চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর পুরস্কার ঘোষণার। আয়নাবাজি চলচ্চিত্রের জন্য মাসুমা রহমান নাবিলা, শঙ্খচিল-এর জন্য কুসুম শিকদার, একই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মনোনয়ন তালিকায় আছে সাঁঝবাতির নামটাও। কে পাবেন পুরস্কার? মঞ্চে আফসানা মিমি উচ্চারণ করলেন, ‘...সাঁঝবাতি!’ নামটা শুনেই মাকে জড়িয়ে ধরল মনোনয়ন তালিকার সর্বকনিষ্ঠ অভিনেত্রী। ছুটে গেল মঞ্চের দিকে। পুরস্কারটা হাতে নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে অশ্রু ঝলমল করে উঠল তার চোখের কোণে।
২১ এপ্রিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বসেছিল মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের ১৯তম আসর। বিনোদন অঙ্গনের অন্যতম বড় এই আসরে আলো ছড়িয়েছেন দেশের নামজাদা তারকারা। এবারের আয়োজনে এসে প্রথমবারের মতো পুরস্কার ঘরে নিয়ে গেলেন সংগীতশিল্পী কনা। পুরস্কার পাওয়ার পর ফেরদৌস তাঁর কাছ থেকে ‘সংক্ষিপ্ত’ প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন। কনা বললেন, ‘সংক্ষিপ্ত বলতে পারব না, আবার একটু আবোলতাবোল কথাও বলব। গত কয়েক বছর ধরে অনেকবার প্রতিক্রিয়া রেডি করেছি, বাসা থেকে রেডি করতে করতে এসেছি। নমিনেশনের সময়ও রেডি করেছি। আসলে অনেক বছর অপেক্ষা করেছি এটার জন্য। মেরিল অনেক বড় একটা প্ল্যাটফর্ম। খুব গোছানো, সুন্দর একটা অনুষ্ঠান। সবাইকে ধন্যবাদ।’
আসলে প্রায় সব দর্শকই এবারের মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানটিকে বলেছেন সুন্দর ও প্রাণবন্ত। প্রশংসা করেছেন পূর্ণিমা ও ফেরদৌসের উপস্থাপনার।

আয়নাবাজির ঢংয়ে নাচছেন সবাই
আয়নাবাজির ঢংয়ে নাচছেন সবাই

মঞ্চে ‘আয়নাবাজি’
সমালোচকদের বিচারে সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তখন মঞ্চে। পুরস্কার পাওয়ার পর উপস্থাপকেরা তাঁকে অনুরোধ করলেন আয়নাবাজির ‘বিশেষ ওই শারীরিক কসরত’টা দেখানোর জন্য। চঞ্চলের প্রশ্ন, ‘কোন শারীরিক কসরত?’ উপস্থাপকদের উত্তর, ‘আরে বোঝো নাই ব্যাপারটা?’ পুরস্কার তুলে দেওয়ার পর তখনো মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করছেন অভিনয়শিল্পী ইনামুল হক ও সুবর্ণা মুস্তাফা। এদিকে চঞ্চল যা বোঝার বুঝে ফেলে মঞ্চে ডেকে আনলেন আয়নাবাজির পরিচালক অমিতাভ রেজাকে। পেছন থেকে আবার টিনের প্লেট হাতে চলে এল একদল ‘কয়েদি’। ব্যস, শুরু হয়ে গেল ‘যা দেখি তা তা না’ গানটা, সঙ্গে ‘বিশেষ শারীরিক’ কসরতসমৃদ্ধ নাচ! চঞ্চলের নাচ তো ছিলই, অমিতাভের নাচ দেখে দর্শকের তালির বিরাম নেই। সঙ্গে যোগ দিলেন ইনামুল হক আর সুবর্ণা মুস্তাফাও! দর্শকের হইহুল্লোড় আর সিটির আওয়াজ শুনে মনে হলো, জেলখানায় চলে এলাম নাকি রে বাবা!

‘কপি’ পুরস্কার নিয়ে সজল, শাওন ও জামিল
‘কপি’ পুরস্কার নিয়ে সজল, শাওন ও জামিল

পুরস্কারের ‘কপি’!
প্রশ্নফাঁসের এই জমানায় নকল নেই বললেই চলে। তবে নকল যে এখনো বহাল তবিয়তে আছে, তা আবার মনে করিয়ে দিলেন ‘মীরাক্কেল’খ্যাত সজল, জামিল ও শাওন। গানের সুর থেকে শুরু করে তাল, লয় যাঁরা ‘কপি’ করেন, তাঁদের তাঁরা ভূষিত করলেন ‘মেরিল-প্রথম আলো কপি পুরস্কারে’। একইভাবে যাঁরা আবার সুরটা গলায় বেঁধে অটোটিউন ব্যবহার করে ইউটিউবে ‘কোটিপতি’ শিল্পী বনে গেছেন, তাঁদের জন্য ছিল ‘বাঁধাকপি’ পুরস্কার। সজল, জামিল আর শাওনদের এই ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনার পর পূর্ণিমা আবার প্রতিভার ঝলক দেখালেন। দেখালেন বললে ভুল হবে, আসলে শোনালেন। ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরও রাত’ গানটা গেয়ে এবার তিনি পূরণ করলেন বেবী নাজনীনের অভাব! এত ‘ভালো’ পারফরম্যান্সের পরও ফেরদৌস খোঁচা দিতে ছাড়েননি, ‘তুমি তো গান গাইলেও পারো, অভিনয়ে যখন ডাক পাচ্ছই না...।’ পূর্ণিমা অবশ্য নাছোড়বান্দা। মঞ্চে কোনো নির্মাতা উঠলেই তাঁদের পরবর্তী নাটক বা সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার জন্য ভীষণ ‘লবিং’ চালিয়ে গেলেন। সেসব দেখে দর্শক হেসেই কূল পায় না।
দর্শক বিমোহিত হলো মমতাজের ‘লোকাল বাস’, মিনারের ‘ঝুম’, শাহতাজের ‘উড়ে যাই’ গানের সঙ্গে পিয়া বিপাশা-সিয়াম, মেহজাবীন-ইমন, সারিকা-রোশানের নাচে। আর আলী বাবা চল্লিশ চোর অবলম্বনে সু কল্যাণ ভট্টাচার্য পরিচালিত গীতিনৃত্যনাট্য বাঁদি-বান্দার রূপকথাও ছিল নজরকাড়া। এর চরিত্রায়ণে ছিলেন শামীম আরা নীপা, শিবলী মহম্মদ, আনিসুল ইসলাম হিরু, নিশাসহ নৃত্যাঞ্চল ও সৃষ্টি কালচারাল সেন্টারের ৫০ জন নৃত্যশিল্পী।

গাইছেন ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী
গাইছেন ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী

আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে...
অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে মঞ্চে এলেন ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী। গাইলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা ও লাকী আখান্দের সুরারোপিত ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’ গানটি। মঞ্চের বিশাল পর্দায় বৃষ্টি পড়ছে, সামনে নৃত্যরত অপি করিম ও তাঁর দল। নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর দরদি কণ্ঠ। সব মিলিয়ে কেমন বৃষ্টিস্নাত এক পরিবেশ। গান শেষে ফেরদৌস বললেন, ‘এই গানের সুরকার কীর্তিমান সংগীত ব্যক্তিত্ব লাকী আখান্দ্ বেশ কিছুদিন থেকেই অসুস্থ। তবে ভালো খবর হলো, সম্প্রতি তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করায় বাড়ি ফিরে গেছেন।’
অনুষ্ঠান তখন শেষ পর্যায়ে। মঞ্চে এলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক। আর্দ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘লাকী আখান্দ্ সত্যিই বাড়ি ফিরে গেছেন!’ সাধারণ দর্শক, বিনোদনজগতের সব তারকা, অনুষ্ঠানের কলাকুশলী আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আবার বেজে উঠল, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়ল তোমায়...’। বাইরে তখন সত্যি সত্যিই বৃষ্টি ঝরছিল, কান্নার মতো! সবারই মনে পড়ল লাকী আখান্দ্কে।