আমার উপহারে তিনি মজা পেয়েছিলেন: ফেরদৌস

শুনেছি, বাসু চ্যাটার্জি তাঁর ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ছবির জন্য আমার বিপরীতে মুনমুন সেনকে ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।

তবে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ছবির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে মুনমুন এসেছিলেন। এরপর থেকে ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ। কয়েক মাস আগেও একটি ছবিতে মুনমুন সেন ও আমার একসঙ্গে অভিনয় করার কথা হচ্ছিল। তখনো তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সুচিত্রা সেন ছাড়া এই পরিবারের সবার সঙ্গে আমার ভালোই যোগাযোগ বলা যেতে পারে। প্রথম দিকে আমি যখন ওই বাড়িটিতে যেতাম, তখন অন্য সবার মতো আমিও সুচিত্রা সেনকে দেখার তীব্র ইচ্ছে পোষণ করতাম। পরে জানতে পারলাম, মুনমুনের বন্ধুরা যাঁরা ১৭-১৮ বছর ধরে ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন, তাঁদের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের কখনো দেখা হয়নি।

একদিন রাতের বেলা দেখলাম, অন্ধকারের মধ্যে বারান্দায় কে যেন বসে আছেন। আমি তখন মুনমুনকে জিজ্ঞেস করলাম, কে তিনি? তখন মুনমুন আমাকে বললেন, তিনি তাঁর মা সুচিত্রা সেন। আমি তখন বুঝতে পারলাম, তিনি তাঁর মতো করে নিজস্ব একটা জগত্ তৈরি করে নিয়েছেন। আর সেটাকে আমাদের অবশ্যই সম্মান করা উচিত। এরপর সেই বাড়িতে গেলেও তাঁকে দেখার যে আগ্রহ, তা আর দেখাতাম না।

অন্য একদিন আমি সুচিত্রা সেনের বাসায় গিয়েছিলাম। ড্রয়িংরুমে তাঁর একটি বড় পেইন্টিং ছিল। ওটি ছিল  তেপায়ার ওপর রাখা। হঠাত্ মনে হলো, ছবিটি বাতাসে পড়ে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ছবিটাকে ঠিক করে জায়গামতো রেখে দিই। আমাকে কাজটি করতে দেখে মুনমুন তখন হেসে  ফেলেন। আমাকে বলেন, ‘বাহ তুমি কী সুন্দর করে মা’র ছবিটা ঠিক করে রাখলে!’
আমি তখনই মুনমুনকে পাল্টা মজা করে বলি, ‘তুমি তোমার মাকে বলো, আমাকে বিয়ে করতে, আমি সারাজীবন তাঁকে যত্ন করে রাখব। হা হা হা।’

পরে জানতে পারলাম, সুচিত্রা সেনকে কথাটি মুনমুন সেন বলেছিলেন। আর এটি শুনে নাকি তিনি খুব হেসেছিলেন।

এর মধ্যে একদিন কথায় কথায় মুনমুন সেনকে বলি, ‘তোমার মাকে আমি কিছু উপহার দিতে চাই।’

আরও বলি, ‘এটা আমার খুবই ইচ্ছে।’ তখন মুনমুন আমাকে জানায়, তার মা (সুচিত্রা সেন) বাংলাদেশি গান খুব পছন্দ করেন। তারপর একদিন অনেক বাংলা গানের সিডি, জামদানি শাড়ি, আমার কিছু ছবিসহ অনেক উপহার নিয়ে যাই। ছবিগুলো দিয়েছিলাম, যাতে তিনি আমাকে চিনতে পারেন। শুনেছি, এসব উপহারে তিনি খুব মজা পেয়েছিলেন। আর গানগুলো শোনার পর সিডিগুলো ফেরত দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমি তখন মুনমুনকে বলি, আমি একবার তাঁকে যে উপহার দিয়েছি, সেগুলো ফেরত নেওয়ার জন্য নয়।

পরিবারের সবার সঙ্গে মিশতে মিশতে একটা সময় গভীরভাবে সুচিত্রা সেনকে উপলব্ধি করতে পারি। মনের মধ্যে দেখা করতে পারার চরম আক্ষেপ থাকলেও পরিবারের অন্য সবার কাছ থেকে সুচিত্রা সেনের খোঁজখবর নিতাম। সর্বশেষ সিঙ্গাপুরে একটি অনুষ্ঠানে রাইমার সঙ্গে দেখা হয়। সেখানে তাঁর কাছে তাদের দিদিমার খবর নিয়েছিলাম।

সুচিত্রা সেন এমন একজন অভিনয়শিল্পী, যিনি জনপ্রিয়তার চূড়ায় থাকাকালে চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। অভিনয়শিল্পীর জীবনে আর কোনো শিল্পী পৃথিবীতে এমন ত্যাগ করেছেন কি না, তা আমার জানা নেই।

আমার ধারণা, সুচিত্রা সেন যে অবস্থা থেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন, সেটা শুধু মানুষের ভালোবাসাটাকে অটুট রাখার জন্যই। তাঁর জীবনের চড়াই-উত্রাই কিংবা বার্ধক্য সময়ের অবস্থাটা দেখলে হয়তো মানুষের ভালোবাসাটা সেই আগের মতো থাকবে না। জানি না কী কারণে তিনি তা করেছেন। এটা পুরোপুরি আমার ধারণা।

আমরা কিন্তু এখনো সুচিত্রা সেন বলতে, সেই ঘাড় বাঁকানো দৃষ্টি ভুলতে পারি না। আর এটুকু মানুষের মনে রেখে যাওয়ার দৃষ্টান্ত যে কোনো অভিনয়শিল্পীর জন্য কঠিন একটা কাজ। অন্যদিকে সুচিত্রা সেন যেসব সৃষ্টি রেখে গেছেন, সে সব অভিনেত্রীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক হয়ে থাকবে বলে আমি মনে করি।