চলে গেলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

সুচিত্রা সেন
সুচিত্রা সেন

দীর্ঘ ২৫ দিন লড়াই করে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। আজ শুক্রবার সকালে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল বেলভিউতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। একমাত্র কন্যা অভিনেত্রী মুনমুন সেন, নাতনি রাইমা ও রিয়া সেনসহ অগণিত ভক্ত ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি। গত ২৩ ডিসেম্বর ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল বেলভিউয়ে ভর্তি হন তিনি।
মহানায়িকার পরিবার জানায়, আজ বিকেলে কলকাতার ঐতিহাসিক কেওড়াতলা মহাশ্মশানে কাঠের চুল্লিতে সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্য হবে। তাঁর মরদেহ দাহ করা হবে চন্দন কাঠে। আজ দুপুরে সুচিত্রা সেনের মরদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হবে তাঁর বালিগঞ্জের বাসভবনে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মরদেহ কেওড়াতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, প্রয়াত সুচিত্রা সেনকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হবে।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সুচিত্রা সেনের চিকিত্সায় সুব্রত মৈত্রের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে। চিকিত্সকেরা জানান, গত তিন দিন তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে অবনতি ঘটে। এরপর আজ সকালে তিনি হূদরোগে আক্রান্ত হন।
সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল, বাংলাদেশের পাবনায়। শৈশব কেটেছে সেখানেই। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন সুচিত্রা। ১৯৪৭ সালে কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দীবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের ঘরে একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন।
১৯৫২ সালে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রথম পা রাখেন। প্রথম ছবি করেন শেষ কোথায়। তবে ছবিটি আর মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে সাড়ে চুয়াত্তর ছবি করে সাড়া ফেলে দেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে। সুচিত্রা সেন বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি দেবদাস (১৯৫৫)। সুচিত্রা সেন ১৯৭৮ সালে প্রণয় পাশা ছবি করার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। এরপর থেকে তিনি আর জনসমক্ষে আসেননি। মাঝে একবার ভোটার পরিচয়পত্রে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ছবি তুলতে ভোটকেন্দ্রে যান। সুচিত্রা সেন ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্ত। একবার তিনি গোপনে কলকাতা বইমেলায় গিয়েছিলেন। বলিউড-টালিউডের বহু পরিচালক সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইলেও তিনি এতে সম্মত হননি। এমনকি দেশ-বিদেশের কোনো পরিচালক বা অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ও দেননি তিনি। সেই থেকে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যান। যদিও তাঁর বাসভবনে তিনি কেবল কথা বলেছেন তাঁর একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রিয়া ও রাইমার সঙ্গে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুচিত্রা সেনের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন মুনমুনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। এ সময় শেখ হাসিনা সুচিত্রা সেনের দ্রুত আরোগ্যও কামনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কয়েক দিন বেলভিউ হাসপাতালে গিয়ে সুচিত্রা সেনের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

সুচিত্রা সেন ১৯৬৩ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে সাত পাকে বাঁধা ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী পান। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলাবিভূষণ সম্মাননা দেওয়া হয় তাঁকে। ২০০৫ সালে সুচিত্রা সেনকে ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে সুচিত্রা সেন দিল্লিতে গিয়ে ওই সম্মান গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সুচিত্রা সেনের ছবি

সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি শেষ কোথায়। ১৯৫২ সালে ছবিটি নির্মিত হলেও তা আর মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে অভিনয় করেন সাত নম্বর কয়েদি ছবিতে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৮ এই ২৬ বছরে তিনি ৬২টি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে তিনি প্রথম ছবি করেন সাড়ে চুয়াত্তর। এ ছবিটি বক্স অফিস হিট করে। সুচিত্রা সেনের অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে : অগ্নি পরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহ প্রবেশ (১৯৫৪), ঢুলি (১৯৫৪), মরণের পরে (১৯৫৪), দেবদাস (১৯৫৫-হিন্দি), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), মেঝ বউ (১৯৫৫), ভালবাসা (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), ত্রিযামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৭), পথে হল দেরী (১৯৫৭),জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), মুশাফির (১৯৫৭-হিন্দি), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), দ্বীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), হসপিটাল (১৯৬০), বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০-হিন্দি), সপ্তপদী (১৯৬১), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), মমতা (১৯৬৬), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), মেঘ কালো (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২), দেবী চৌধুরাণী (১৯৭৪), শ্রাবণ সন্ধ্যা (১৯৭৪), প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫), আঁধি (১৯৭৫-হিন্দি), দত্তা (১৯৭৬) এবং সর্বশেষ প্রণয়পাশা (১৯৭৮)।