রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতায় বর্ষামঙ্গল

বর্ষা এখন নগরজীবনের নিত্যসঙ্গী। ঘোর বর্ষা দেখলেই নগরবাসী আতঙ্ক বোধ করেন। তারপরও গতকাল শুক্রবার রাতে রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তন পরিপূর্ণ দর্শকদের মনে হয়েছে, বাইরে ঝুম বৃষ্টি হলেই মনে হয় ভালো হতো। মিলনায়তনের ভেতরে তখন একদল শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় বর্ষামঙ্গলে ব্যস্ত।

বর্ষামঙ্গলের এই গান-কবিতার আসরের আয়োজন করে ‘না-গান গাওয়ার দল’। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবারই এই ধারণা হয়েছে, আত্মার কথাগুলো যখন সুর হয়ে বের হয়, তখন আর আলাদা করে গাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কথা আর সুর মিলে অদ্ভুত সুন্দর এক কাব্য হয়ে যায়। মিলনায়তনের ভেতরে আলো-আঁধারির অপার্থিব একটা জগৎ, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই। তবে আসনস্বল্পতার কারণে অনেক দর্শকই মিলনায়তনের ভেতরে ঢুকতে পারেননি।

শস্য-শ্যামল, নদীবিধৌত বঙ্গভূমির ঋতু উৎসব পালনের ঐতিহ্য বহুদিনের। বঙ্গ বদ্বীপে বর্ষা মাঝে মাঝে প্রলয়ংকরী রূপ ধারণ করে। তাই বর্ষার আবির্ভাব যেন সমাজজীবনে মঙ্গলময় হয়, সেই কামনায় বহুকাল আগে থেকেই বাংলার বুকে উদ্‌যাপিত হয় বর্ষামঙ্গলের উৎসব। আয়োজকেরা জানান, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের হাতেই এই উৎসবের সূচনা। মানবহৃদয়ে বর্ষা এক অদ্ভুত আবেগের ঢেউ তুলেছে সব সময়, যার প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এক অদ্ভুত বর্ষা ঋতুর সঙ্গে। প্রকৃতি, সমাজ, মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের সুর ও বাণীর অমিত বন্ধনে। ‘না-গান গাওয়ার দল’ বর্ষামঙ্গলের এই উৎসবের আয়োজন করেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ঢাকার উৎসবটি ছিল গতকাল। চট্টগ্রামে থিয়েটার ইনস্টিটিউটে হবে ১৪ আগস্ট।

সম্মিলিত কণ্ঠে ‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে’ ও ‘নমো নমো নমো করুণাঘন, নমো হে’ দিয়ে শুরু হয় বর্ষামঙ্গল। তারপর একে একে সুর আছড়ে পড়ে মিলনায়তনের প্রতিটি কোণে। কখনো কৃষ্ণকলির রূপের বর্ণনা, কখনো মেঘের সঙ্গী হতে মনের আকুতি কিংবা কখনো বহু যুগের ওপার হতে ঘন গৌরবে নবযৌবনা বরষা, শ্যাম গম্ভীর সরসায় বর্ষার আগমনী গান। সঙ্গে ছিল ছিন্নপত্রাবলী, লিপিকা ও অন্যত্র থেকে পাঠ।

দর্শকদের সামনে একে একে পরিবেশিত হলো ‘এসো শ্যামল সুন্দর’, ‘শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ন সন্ধ্যায়’, ‘যায় দিন শ্রাবণদিন যায়’, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ প্রভৃতি। কখনো সম্মিলিত কণ্ঠে, কখনো একক বা দ্বৈত কণ্ঠে ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, ‘বাদলদিনের প্রথম কদমফুল’।

দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা ‘না-গান গাওয়ার দল’-এর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অভিজিত দাস, সেঁজুতি বড়ুয়া, সোমা চৌধুরী, অভিজিৎ মজুমদার, আইরিন পারভীন, তানিমা ইসলাম, তারেক হাসান, প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য, সুকান্ত চক্রবর্তী, সুশান্ত রায় প্রমুখ।

গান-কবিতায় কখন যে দুই ঘণ্টার অধিক সময় কেটে গেছে, তা টের পাওয়া যায়নি। ‘পাগলা হাওয়ার বাদলদিনে’ আর ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দরকান্তি’র সুরে অনুষ্ঠান শেষ হলেও তার রেশ রয়ে যায় সব ভক্ত-শ্রোতার মনে। অনুষ্ঠানস্থল থেকে ঘরে ফেরার সময় তাই সবার মনে হচ্ছিল, ভালো লাগা একটি সন্ধ্যা কেনইবা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।