শেষ দিন পর্যন্ত ভেবেছেন বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে

নায়করাজ রাজ্জাক
নায়করাজ রাজ্জাক

২৪ জুলাই ২০১৭। সোমবার সন্ধ্যা। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মূল মিলনায়তন থেকে বের হতেই দেখা নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে। লালচে রঙের পাঞ্জাবি পরে চেয়ারে বসে আছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শেষ। বাড়ি যাওয়ার তাড়া। অসুস্থতার কারণে সময়মতো ওষুধ খেতে হয়। ইচ্ছে থাকার পরও কোনো অনুষ্ঠানে বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন রাজ্জাক। বললেন, ‘দেশের সিনেমার এমন অবস্থা হবে কখনোই ভাবিনি। কী এক সংস্কৃতি শুরু হয়েছে!’
এমন সময় এলেন নায়ক শাকিব খান। কিছুক্ষণ কথা বললেন দুই প্রজন্মের দুই তারকা।
শিল্পী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন। শাকিব খান ইস্যু থেকে এর রেশ যায় রাজ্জাক পর্যন্ত। সবকিছু নিয়ে রাজ্জাককে মনে হচ্ছিল অসহায়। বলছিলেন, ‌‘আমাদের দেশের সিনেমায় এর চেয়েও অনেক কঠিন সময় গেছে। চলচ্চিত্রের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কখনোই এফডিসি পাড়া থেকে ওসব খবর বাইরে যেতে দিইনি। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করেছি। আমাদের সময়কার সমস্যার তুলনায় এখনকার সমস্যা তো কিছুই না। এসব সমস্যার কথা বাইরে এনে তো সবাই নিজেদেরই সম্মান নষ্ট করছে। দেশের সিনেমার এমন দৃশ্য দেখতে হবে কখনোই আশা করিনি!’
রাজ্জাককে কাতর দেখায়। বোঝা যায়, এখনো কতটা ভালোবাসেন এই চলচ্চিত্র অঙ্গনকে। প্রতিটা মুহূর্ত ভাবেন এর ভালোমন্দ নিয়ে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নামকাওয়াস্তে যৌথ প্রযোজনায় ছবি বানানোর ঘোর বিরোধীও ছিলেন। বলছিলেন, ‌‘এখন যৌথ প্রযোজনার নামে যা হচ্ছে তা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য আত্মঘাতী। এটা চলচ্চিত্রের খারাপ অবস্থায় শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতোই। যৌথ প্রযোজনার যে নিয়ম এখন তা কেউই মানছে না।’
অতীতের উদাহরণ টেনে বলছিলেন, ‘১৯৭৩ সালে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রথম ছবিটি ছিল আলমগীর কবিরের পরিচালনায় “ধীরে বহে মেঘনা”। একই বছর ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত “তিতাস একটি নদীর নাম” ছবিটি মুক্তি পায়। শুধু ভারতের সঙ্গেই নয়। ১৯৮৩ সালে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান—তিন দেশের প্রযোজনায় “দূরদেশ” ছবিটি নির্মিত হয়। এরপরও যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মিত হতে থাকে। তবে সে সময় কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলতে হতো।’
বাংলা সিনেমার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব তৈরি হওয়া প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমরা পাকিস্তান আমলে উর্দু ছবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলা ছবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির শুটিং করার সময় পাকিস্তানি আর্মি এফডিসির ফ্লোর ঘেরাও করে ফেলল। আমাকে এবং জহির রায়হানকে আর্মি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেল।’ হতাশ হয়ে বলছিলেন, ‌‌‘আমাদের নৈতিক চরিত্র এতটাই অবক্ষয় হয়েছে যে এখন আমাদের প্রভাত ফেরিও হয় না।’
এখন সবাই সাফল্যের সিঁড়ি দ্রুত ভাঙতে চায়। দ্রুত চায় সাফল্য। এটাও ভাবায় তাঁকে, ‘এই আমি অভিনয় শিখে চলচ্চিত্রে এসেছিলাম। কিন্তু তারপরও নায়ক হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করতে পারিনি। নায়ক আমি একদিনে হইনি।’
৭৫ পেরিয়েও বাংলা চলচ্চিত্রের নিজের সামর্থ্যের সবটুকু করতে চেয়েছিলেন। প্রত্যয় নিয়ে বলছিলেন, ‘আমাদের সবারই বয়স হয়েছে। আমরা তো এখন আর সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকতে পারব না। এখন যারা নতুন, যারা নেতৃত্বে আছে তারা আমাদের কাছে যদি বুদ্ধি পরামর্শ চায়, আমরা সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের কারও কাছে কেউ চলচ্চিত্রের অগ্রগতির জন্য কথা বলতে আসে না। চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি এবং চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি যদি চলচ্চিত্র উন্নয়নে যথাযথ উদ্যোগ এবং কঠোর পদক্ষেপ নিত, আমাদের চলচ্চিত্রের এ অবস্থা হতো না।’