শোকাকুল হৃদয়ে নায়ককে বিদায়

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নায়করাজ রাজ্জাককে শেষ শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ l প্রথম আলো
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নায়করাজ রাজ্জাককে শেষ শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ l প্রথম আলো

গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার কিছু পরে ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে এফডিসিতে নিয়ে আসা হয় নায়করাজ রাজ্জাকের মরদেহ। বৃষ্টি শেষের স্নিগ্ধ প্রকৃতি, তপ্ত রোদে লাশবাহী শীতল গাড়ি ঢোকে নায়কের কর্মস্থল এফডিসিতে। মূল ফটকের বাইরের সড়কদ্বীপে ততক্ষণে মানুষের জটলা তৈরি হয়। এফডিসির প্রশাসনিক ভবনের বাইরে লাশবাহী গাড়ি সামনে রেখে শুরু হয় জানাজা। চলচ্চিত্রের দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং অনুজপ্রতিম শিল্পী ও কলাকুশলীদের বিশাল একটি দল অংশ নেয় নায়করাজ রাজ্জাকের প্রথম জানাজায়। এরপর সারি বেধে তাঁকে একনজর দেখে নেন সবাই। বিহ্বল মুখে আসেন কবরী, কান্নাভেজা চোখে ববিতা, কালো বোরকায় শাবনূর, সাদা পাঞ্জাবি পরে শাকিবসহ উপস্থিত হয়েছিলেন বড় পর্দার সামনে-পেছনের বহু কর্মী। শ্রান্ত, অবসন্ন মুখে বয়স্ক শিল্পীদের সমবেদনা জানাচ্ছিলেন নায়ক আলমগীর। ফোনে রাজ্জাকের মৃত্যুর সংবাদ সবাইকে জানিয়ে, গণমাধ্যমকে হালনাগাদ তথ্য জানাতে জানাতে ক্লান্ত তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগরকে দেখা গেল নতুন ফুলের জায়গা করে দিতে পুরোনো ফুল সরাচ্ছিলেন অস্থায়ী মঞ্চ থেকে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান ঠিক করে দিচ্ছিলেন মানুষের সারি।

এখান থেকে রাজ্জাকের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শহীদ মিনারে।

 শহীদ মিনারে ভক্তদের ঢল

গতকাল পথঘাট ছিল যানজটে শৃঙ্খলিত। তবু রাজ্জাকের মরদেহ আসার খবরে দুপুর সাড়ে ১২টার আগেই শহীদ মিনার লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কালো ব্যানারের নিচে রাখা হয় সাদা কাপড়ে মোড়া নায়কের মরদেহ। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে চারপাশ। শেষবারের মতো ফুল দিতে এসেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন বয়সী নারীদের একটি দীর্ঘ সারি। ভিড়, ঠেলাঠেলি উপেক্ষা করে তাঁরা একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন নায়কের মরদেহের দিকে। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ মাইকে একে একে ডেকে নিচ্ছিলেন সংগঠনগুলোকে। ঘামে ভেজা মানুষগুলোকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় রাজ্জাকের মরদেহের পাশে ছিলেন দুই সন্তান বাপ্পারাজ ও সম্রাট, চিত্রনায়ক জাভেদ ও শাকিব খান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। ঘেমেনেয়ে একাকার হাজার ভক্তকে ঠেলে রোজিনা এলেন শহীদ মিনারে। বললেন, ‘আমার জীবনের প্রথম ছবি আয়নায় তাঁকে পেয়েছিলাম নায়ক হিসেবে। অভিনয় করতে গিয়ে হাত-পা কাঁপছিল। সেটা বুঝে তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, “তোমার অভিনয় ভালো হচ্ছে।”’

শহীদ মিনারে এসেছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের পথিকৃৎ রাজ্জাক ভাইয়ের অবদান ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে ভেবেছেন।’ সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘যে ব্যক্তির ওপর ভর দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র দাঁড়িয়েছিল, তিনি রাজ্জাক। নিজের দক্ষতা, নিজের গুণে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রধান স্থপতি আজ চলে গেলেন।’

 আওয়ামী লীগের পক্ষে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দীর্ঘ পাঁচ দশক তিনি আমাদের চলচ্চিত্রে অবদান রেখেছেন। তাঁর চলে যাওয়ার ক্ষতি অপূরণীয়। রাজ্জাক ছিলেন এই বাংলার উত্তম কুমার।’ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘রাজ্জাকের বিনয়ের প্রেমে পড়েনি এমন মানুষ বোধ হয় নেই। এত জনপ্রিয় হয়েও সে তার অতীতকে ভোলেনি। সব শ্রেণির মানুষকে সে শ্রদ্ধা করত।’ আতাউর রহমান বলেন, ‘আমি ওর চেয়ে বয়সে মাত্র এক বছরের বড়। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। সে আমার রক্তকরবী দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল।’ অভিনেত্রী জয়া আহসান বলেন, ‘তাঁর বাচনভঙ্গি থেকে শুরু করে সবকিছু দারুণ মার্জিত। হিরো হিসেবে এ রকম নিখুঁত একজন মানুষ এখন আর দেখি না। যাওয়ার সময় হলে তো সবাই যায়, কিন্তু তার রেখে যাওয়া জায়গাটা আর কখনোই পূরণ হবে না।’

এফডিসি, শহীদ মিনার ও গুলশানে নায়করাজকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার, সুব্রত, আলীরাজ, রুবেল, ফেরদৌস, ওমর সানী, সাইমন সাদিক, রোশান, আরিফিন শুভ, বুবলী প্রমুখ। সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবার, সিনেম্যাক্স মুভি পরিবার, বাংলাদেশ আওয়ামী সাংস্কৃতিক লীগ, বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাব, চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থা, চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি, সিনে স্থির চিত্রগ্রাহক সমিতি, জাসাসসহ বিভিন্ন সংগঠন। বিএনপির পক্ষে আসেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। শহীদ মিনারে সংগঠনগুলোর মধ্যে আসে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, অভিনয় শিল্পী সংঘ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়ার্কার্স পার্টি, দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদ, মুক্তধারা সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, সুবচন নাট্য সংসদ, ডিরেক্টরস গিল্ড, এনটিভি, দেশ টিভি, প্রজন্ম ’৭১, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিসহ আরও বেশ কিছু সংগঠন।

গতকাল আসরের নামাজের পর গুলশানের আজাদ মসজিদে নায়কের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাঁর মরদেহ আবারও নিয়ে যাওয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে। মেজ ছেলে ফিরলে আজ বুধবার সকাল ১০টায় তাঁকে দাফন করার কথা বনানী কবরস্থানে।

 তিন দিনের কর্মবিরতি

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, নায়করাজের প্রয়াণে তিন দিনের কর্মবিরতির কর্মসূচি নিয়েছেন তাঁরা। এই তিন দিন কালো ব্যাজ ধারণ করবেন সবাই, এফডিসি ওড়াবে কালো পতাকা। শোকসভা হবে, আলোচনা হবে নায়করাজের জীবন নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের পিতাকে, অভিভাবককে হারিয়েছি। তাঁর অভাব অপূরণীয়।’