আয়নাবাজদের আড্ডাবাজি

আয়নাবাজির সাফল্য চঞ্চল চৌধুরীকে মুশকিলে ফেলে দিয়েছে। নির্মাণের পুরোটা সময় পরিচালক অমিতাভের গেছে ট্রমার ভেতর দিয়ে। অভিনেতা লুৎফর রহমান জর্জের কাছে ছবিটি ছিল ট্রমা থেকে মুক্তি। আয়নাবাজি মুক্তির এক বছর উপলক্ষে রোববার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর পঞ্চম তলার সভাকক্ষের আড্ডায় উঠে আসে এমন অনেক কথা। সাক্ষী থাকলেন

২০ থেকে ৭৫

বেশ খানিকটা আগে সন্ধ্যা নেমেছে যানজটের নগরে। গাউসুল আলম শাওন এসেছেন সবার আগে, তারপরই পরিচালক অমিতাভ রেজা। যানজটে পড়েছিলেন চঞ্চল। তবে খুব একটা দেরি হয়নি। তারপরই নাবিলার আগমন। শেষে জর্জ।

পরিচালক অ্যাকশন বলার পর কাজ শুরু করেন ক্যামেরার সামনে থাকা শিল্পীরা। কাকতালীয়ভাবে আড্ডাটাও শুরু হলো পরিচালকের সূত্রে। চঞ্চল, কী অবস্থা আপনার? আয়নাবাজির এক বছর পর?

আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন পেছনে (বাঁ থেকে) গাউসুল আলম, লুৎফর রহমান জর্জ, সামনে (বাঁ থেকে) নাবিলা, অমিতাভ রেজা চৌধুরী ও চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: কবির হোসেন
আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন পেছনে (বাঁ থেকে) গাউসুল আলম, লুৎফর রহমান জর্জ, সামনে (বাঁ থেকে) নাবিলা, অমিতাভ রেজা চৌধুরী ও চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: কবির হোসেন

অমিতাভ রেজার প্রশ্নটার জন্য যেন অপেক্ষায় ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। বললেন, ‘অনেক মুশকিলে আছি। এখন অনেক মেপেঝেপে কথা বলতে হয়, চলতে হয়। মনমেজাজ খারাপ হলেও প্রকাশ করা যায় না। পেছনে যদি কেউ ভেবে বসে, আয়নাবাজির পর ‘ভাব’ বেড়েছে! কাজ বেড়েছে। আবার এমনও হয়েছে, আগে কাজ করেছেন এমন অনেক নির্মাতা দ্বিধায় পড়েছেন, সম্মানী বাড়িয়ে দিয়েছি কি না। এমনকি ঘরেও জোর গলায় কথা বলতে পারি না! ভাববে আয়নাবাজি আমাকে বদলে দিয়েছে!’

এমন মধুর যন্ত্রণায় পড়ার ভাবনাটা চঞ্চলের জন্য মোটেও অমূলক নয়। আসলে আয়নাবাজির সাফল্যটা সেই মাত্রায় পৌঁছেছিল। নিরুত্তাপ ও মৃতপ্রায় প্রেক্ষাগৃহে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল ছবিটি। ছবি দেখতে আসা শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, তরুণ দর্শক কোলাহল এনেছিল সিনেমা হলে। টিকিট কাউন্টারের আশপাশে ‘ব্ল্যাকাররা’ ফিরেছিলেন। ‘হাউসফুল’ লেখা উঠেছিল দরজায়।

শুরুতে আয়নাবাজি মুক্তি পেয়েছিল মাত্র ২০টি হলে। নিতে চায়নি অনেক হলমালিক। চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক ও অভিনেতা শাওনের কথায় সেই অভিজ্ঞতাই জানা গেল, ‘আমরা তো টেনশনেই ছিলাম এটা চলবে কি না। প্রথমে অনেকে নিতে চায়নি। শেষে ৭৫টি হলে গিয়ে ঠেকেছিল। রাজধানীর অভিজাত হলগুলো দিনের পর দিন চালিয়েছে ছবিটি।’

সিক্যুয়েল হবে কী?

এখন তো প্রায় রীতি হয়ে গেছে, ছবি সাফল্য পেলে প্রযোজক-পরিচালকেরা সিক্যুয়েলের কথা ভাবেন। আয়নাবাজির ক্ষেত্রেও কি তেমন ভাবনা আছে? বাংলাদেশের দর্শক কি তেমন কিছু আশা করতে পারে না? এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে পরিচালক অমিতাভ রেজাকে একটু অভিমানী মনে হলো-‘আর না, আয়নাবাজির পুরোটা সময় আমি একটা ট্রমার ভেতর দিয়ে গেছি। আর সেই অবস্থায় যেতে চাই না।’

আয়নাবাজি ছবির দৃশ্যে নাবিলা ও চঞ্চল চৌধুরী
আয়নাবাজি ছবির দৃশ্যে নাবিলা ও চঞ্চল চৌধুরী

‘প্রশ্ন’জাগানো এমন জবাবের ব্যাখ্যাও দিলেন পরিচালক। দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমি সিনেমা করেই থাকতে চাই। আর কিছু চাই না সিনেমা ছাড়া। কিন্তু আমার কষ্ট একটাই, কেন পরিচালক হয়ে আমাকে আয়নাবাজির পরও আরেকটি ছবি নির্মাণের জন্য এত ভাবতে হয়!’ বিনয়ী অমিতাভ বললেন, ‘আয়নাবাজির দলে আমি সবচেয়ে কম মেধাবী লোক ছিলাম। পুরো দলই ছিল মেধাবী কলাকুশলীতে ভরপুর। কিন্তু এই দলটাকে ধরে রাখা যায়নি। সবাই এখন যার যার আলাদা পথে চলে গেছে।’ কথা প্রসঙ্গে অমিতাভ আয়নাবাজির চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামান, চিত্রনাট্যকার গাউসুল আলম শাওন ও অনম বিশ্বাস, আবহসংগীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত-নামগুলো ধরে তাঁদের ভালো কাজের প্রশংসা করলেন। (পরে বিদায়বেলায় লিফটের সামনে এই প্রতিবেদককে বললেন, নামগুলো মনে আছে তো?)।

বোঝা গেল, যে দায় প্রযোজকের, সে দায়ের কথাই মনে করিয়ে দিলেন অমিতাভ। সিক্যুয়েল হতে হলে তো অর্থলগ্নিকারীরাই এগিয়ে আসবেন। আপাতত তাই সিক্যুয়েলের সম্ভাবনা নেই।

সে এক শহরের গল্প

আয়নাবাজি সেই শহরের গল্প শুনিয়েছে, যে শহরে এখনো সকালে দুধওয়ালা আসে, ফেরিওয়ালারা হাঁকডাক দেয়, বাচ্চারা দল বেঁধে অভিনয় শিখতে যায়। মহল্লার চা-পুরির দোকানে ঠাট্টা-মশকরা করে বেকার-বখাটেরা। ‘আয়না’ সেই শহরের একজন বাসিন্দা। যার সঙ্গে সহজাত প্রেম হয়ে যায় ‘হৃদি’ চরিত্রের নাবিলার। অভিনেত্রী নাবিলার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল আয়নাবাজি। আড্ডায় তিনি সবচেয়ে কম কথা বললেন। শরীরসচেতন অভিনেত্রী সন্ধ্যার নাশতার অল্পটাই মুখে তুললেন। জানালেন, আয়নাবাজির সাফল্যের পর কাজ তুলনামূলকভাবে কমে গেছে, অর্থাৎ তিনি নিজে কমিয়ে দিয়েছেন। এর একটা ব্যাখ্যাও দিলেন, ‘এখন দর্শকের কাছে নিজেকে অনেক দায়বদ্ধ মনে হচ্ছে। কেউ যেন কাজ নিয়ে মন্দ কথা বলতে না পারেন, সেদিকে বেশি খেয়াল রাখতে হচ্ছে।’ আরেক প্রসঙ্গে নাবিলা জানালেন, আয়নাবাজির সময় একটা জীবন পার করেছেন, যেটা জীবনের অন্যতম সেরা সময়। শুটিংয়ের শেষ দিন নাকি হু হু করে কেঁদেছেন। শুটিংয়ের দিনগুলোর কত মজার স্মৃতি জমা আছে!

লুৎফর রহমান জর্জের কাছ থেকেও কম কথা শোনা গেল। যতটুকু বলেছেন, এক আধো সমালোচনায় ছবির দুর্বল দিকগুলোর প্রসঙ্গ এনেছেন। ছবির অভিজ্ঞতা আরও আছে তাঁর। তবে আয়নাবাজি তাঁর কাছে স্পেশাল। শারীরিক, মানসিকভাবে একটু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন জর্জ। তাঁর ভাষায়, ‘ট্রমার মধ্যে ছিলাম, সেখান থেকে উদ্ধার করেছে আয়নাবাজি।’

কথায় কথায় কত স্মৃতি

কথায় কথায় আয়নাবাজির পেছনের অনেক গল্প শোনা গেল। যেমন চঞ্চল জানালেন, ছবিতে অন্যের অনুকরণ করতে দেখা যায় তাঁকে। কিন্তু এই দৃশ্যগুলোতে চঞ্চলই আগে অভিনয় করেছেন। কেননা, লুৎফর রহমান জর্জ তখন ব্যস্ত ছিলেন। আসতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে পরিচালক চঞ্চলের অংশটিই প্রথমে ধারণ করেন। জর্জের সঙ্গে আগে অনেক কাজ করেছেন। তাঁর হাঁটাচলা, কথা বলার একটা ধারণা ছিল চঞ্চলের। এ কারণে সমস্যা হয়নি।

আরও অনেক অজানা তথ্য উঠে এল আড্ডায়। আদালত আর পুরান ঢাকার পুরির দোকান ছাড়া বেশির ভাগ দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল কৃত্রিম সেট না বানিয়ে। জেলের দৃশ্য ধারণ করতে করতে রীতিমতো কয়েদিদের ভক্ত হয়ে যান পরিচালক অমিতাভ। যত বড় আসামি, তত বেশি মায়া। পিস্তল দিয়ে গুলি করে মারা খুনের আসামিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন অমিতাভ!

জেলখানার নাচের দৃশ্যটি দেখে বোঝার উপায় নেই কোনো নৃত্য পরিচালক ছিল না এটির। চঞ্চলকে বলা হয়েছিল নাচতে। কীভাবে নাচতে হবে, সেটা বলে দেওয়া হয়নি। চঞ্চল মাথায় আনলেন, কীভাবে একজন মন্দ লোক নাচতে পারে। সেই ভাবনা থেকে নিজের মতো করে ‘না বুঝি দুনিয়া না বুঝি তোমায়’ গানের সঙ্গে নেচে গেলেন চঞ্চল।

বাদ পড়া দৃশ্য

অনেক বাদ পড়া দৃশ্য নিয়ে আফসোসও হয়। কারাগারের ভেতরে একটা ঘর হঠাৎ নজরে এল পরিচালকের। দীর্ঘদিন জেল খাটা এক কয়েদি সেখানে বন্দী, প্রায় বৃদ্ধ। সংলাপ ঠিক হলো, শুধু ওপরে তাকিয়ে চঞ্চল কাঁদবেন আর মাকে ডাকবেন। তাই করতে থাকলেন চঞ্চল। চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে, এমন সময় ওই বয়স্ক আসামি নিজের গামছা দিয়ে চঞ্চলের চোখ মুছে দিয়ে বলতে থাকেন, ‘মারে ডাইকা কী লাভ, মা কি আর আইব!’ এই দৃশ্যটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়নি। তবে পরিচালক, অভিনেতার মনে বেশ দাগ কেটেছে দৃশ্যটি।

আড্ডা হলো শেষ

অনেকটা সময় কেটে গেল কথা, হই-হট্টগোলে। নির্দিষ্ট কোনো বিষয় ছাড়াই আড্ডা জমে ওঠে। ছবি তোলার জন্য পাঁচ আয়নাবাজ প্রথম আলোর স্টুডিওতে প্রাণবন্ত। হাসি, খুনসুটি সেখানেও চলতে থাকে। বের হওয়ার সময় অভিনেতা চঞ্চল প্রতিবেদককে লক্ষ্য করে বলেন, ‘কই, আয়নাবাজির সিক্যুয়াল হবে কি না, সে ব্যাপারটার তো কোনো ফয়সালা হলো না। পরিচালককে জিজ্ঞেস করুন, নায়ক কি একই থাকবে?’

পরিচালকও জবাব দেন, ‘সিক্যুয়াল হোক, তবে আমি আর এসবের মধ্যে নেই।’

অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকার গাউসুল আলম জানালেন, ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তির এক বছর উপলক্ষে সবাইকে নিয়ে একটি আয়োজন করার ইচ্ছা আছে। ওইদিন বেলা ১২টায় রাজধানীর শ্যামলী সিনেমা হলে থাকছে একটি বিশেষ প্রদর্শনী। শুক্রবার সারাদিন প্রেক্ষাগৃহ থেকে টিকিট সংগ্রহ করা যাবে।

যাঁদের পর্দায় আয়নাবাজি

l তখন ভয়ংকর রকমের দর্শক-খরা ছিল হলে। আয়নাবাজি সেই খরায় বৃষ্টি ঝরার কাজ করেছে। এর মূল কারণ এর গল্প। গল্পটি সহজ ছিল, অকারণে পরিচালক জটিল করেননি। সেখানে অপরাধ থেকে শুরু করে প্রেম-ভালোবাসা, মানবিকতা সবই ছিল। এ কারণেই দর্শক ছবিটা ভালোমতো নিয়েছে। আমাদের হলে ছবিটি ৮ সপ্তাহ চলেছে। প্রথম দিকে ওঠাতে পারলে হয়তো আরও বেশি চলত।

ইফতেখার উদ্দীন নওশাদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মধুমিতা।

l অনেক দিন পর মানুষকে লাইন ধরে হলে ঢুকতে দেখেছি আয়নাবাজির সময়। মনটাই ভালো হয়ে যেত। ছাত্রছাত্রীর পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে গাড়ি নিয়ে নানা বয়সের দর্শক এসেছে। তিন মাস আমাদের পর্দায় ছবিটি চলেছে কোনো রকমের দর্শক সংকট ছাড়াই। কেননা চলচ্চিত্রটির পুরো গল্পে ছিল টানটান উত্তেজনা। সেই সঙ্গে পুরো ছবিতে চমক ও কৌতুকপূর্ণ সংলাপ। সব শিল্পীর অভিনয় দর্শককে আনন্দ দিয়েছে। দর্শক হেসেছে, তালি দিয়েছে।

মোহাম্মদ হাসান ইমাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বলাকা।

l আয়নাবাজি মুক্তির দুই সপ্তাহ আগে (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬) ঈদের ছুটিতেও এতটা জমজমাট ছিল না, যতটা আয়নাবাজির মুক্তির পর হয়েছে। ঈদের ছুটিতেও কাউন্টারে অলস বসে থাকতে দেখা গেছে প্রেক্ষাগৃহের কর্মচারীদের। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরতেই আলমাসের চিত্র পাল্টে গেল। টানা কয়েক সপ্তাহ চলল ছবিটি। প্রতিদিনের সব কটি প্রদর্শনীতেই দর্শকের লম্বা লাইন সেখানে। আমি মনে করি, দেখার মতো ছবি হলে মানুষ ঠিকই আসবে।

এম এ কাদের খন্দকার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আলমাস সিনেমা হল, চট্টগ্রাম।

l অনেক দিন পর ‘হাউসফুল’ নোটিশ লেখা উঠেছিল উপহারে। ১ হাজার ৫ আসনসংখ্যা আছে। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির দর্শক ফিরে এসেছিল হলে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ থেকে প্রচুর স্টুডেন্ট এসেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এ শ্রেণিটা আসলে উন্মুখ হয়ে ছিল একটি ভালো চলচ্চিত্রের জন্য। আয়নাবাজি সেই ক্ষুধা মিটিয়েছে। আমাদের এখানে টানা তিন সপ্তাহ চলেছে ছবিটি।

সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, চেয়ারম্যান, উপহার হল, রাজশাহী।