জীবনেও রাজনীতিতে যাব না

আমির খান, নতুন ছবি সিক্রেট সুপারস্টার-এর মূল চরিত্রের বেশে
আমির খান, নতুন ছবি সিক্রেট সুপারস্টার-এর মূল চরিত্রের বেশে

আমির খান এবার হেঁকেছেন এক বলে দুই ছক্কা। বছরে একটির বেশি ছবিতে জড়াবেন না, নিজের জন্য এমন একটি অলিখিত নিয়মই প্রায় অবধারিত করে তুলেছিলেন বলিউডের এই জনপ্রিয় মহাতারকা। কিন্তু এ বছর জোরেশোরে উঠল তাঁর দুটো ছবির নাম। একটি সিক্রেট সুপারস্টার, নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে। ভারতজুড়ে মুক্তি পাচ্ছে আজই। অন্যটি থাগস অব হিন্দোস্তান। এর কাজ এখনো চলছে। এই প্রথমবারের মতো তাঁর কাজ করার সুযোগ মিলল অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে। ছবিটি আলোর চেহারা দেখবে আগামী বছরের নভেম্বরে, দিওয়ালি উৎসবে। সিক্রেট সুপারস্টার­-এর মুক্তি উপলক্ষেই ১ অক্টোবর মুম্বাইয়ের বান্দ্রার ফ্রিডা অ্যাপার্টমেন্টে আমিরের অফিসে বসল এক বৈকালিক আড্ডা।

কিন্তু আমির খান বলে কথা। আলাপ কি আর নিছক চলচ্চিত্রে আটকে থাকতে পারে! ছবি ছাপিয়ে চলে এল সমাজ আর রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ। মহারাষ্ট্রের খরাদুষ্ট জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ানোর কাজে দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তিনি। কিন্তু স্পষ্ট করে বলে দিলেন, এর পেছনে আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাঁর লাভ মানুষের অনাবিল সান্নিধ্য। এখনো তাঁর ভালোবাসা চলচ্চিত্র।

অভিনেতা হিসেবে আমির খানের অভিষেক হয়েছিল মুম্বাইয়ের চলতি ছবির ধারাতেই। কিন্তু সেখানকার চিরচেনা নায়কের ভাবমূর্তি ভেঙে ক্রমশ নিজের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলেন তিনি। অভিনেতা থেকে হন প্রযোজক, পরে পরিচালক।

২০১২ সালে আমির খান প্রথমবারের মতো পা রাখেন চলচ্চিত্রের বাইরে, টেলিভিশনে। সামাজিক বৈষম্য ও অসংগতি নিয়ে সত্যমেব জয়তে করে নাড়া ফেলে দেন। কেবল ভারতে নয়, বিশ্বজুড়ে। সে বছরই টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনি বের করে। ২০১৩ সালে তিনি উঠে আসেন এ ম্যাগাজিনের নির্বাচিত ১০০ জন প্রভাবশালী বিশ্বব্যক্তিত্বের তালিকায়। পর্দার নায়ক হয়ে ওঠেন সামাজিক পরিবর্তনের অগ্রদূত।

স্ত্রী কিরণ রাও ও বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘পানি ফাউন্ডেশন’, খরা-উপদ্রুত মহারাষ্ট্রের মাটি কৃষকদের জন্য সজীব করে তোলার লক্ষ্যে। পৃথিবীর শীর্ষ জনসংখ্যাবহুল দুই দেশ চীন ও ভারতে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা দেখে ফোর্বস ম্যাগাজিন যাঁকে বলেছিল বিশ্বের জনপ্রিয়তম অভিনেতা, সেই আমির খানের সঙ্গে কথা তাই ছড়িয়ে যায় নানা প্রসঙ্গে।

নতুন ছবি মুক্তির আগে আমির খান আছেন রীতিমতো ফুর্তির মেজাজে। বললেন, সিক্রেট সুপারস্টার ছবির শক্তি কুমারের চরিত্রটি ছিল তাঁর জন্য অসম্ভব চ্যালেঞ্জের। অভিনয়ে যেমন, গেটআপেও তার চেয়ে কম নয়। থাগস অব হিন্দোস্তান ছবিতে এই প্রথম সুযোগ মিলল অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করার। কত কী যে শিখলেন ও জানলেন তাঁর কাছ থেকে। প্রসঙ্গান্তরে বললেন, সত্যমেব জয়তে শেষ হয়েছে, কিন্তু কর্তব্য নয়। তাঁর সামাজিক তৎপরতা জোর কদমে চলছে। সেই সূত্র ধরে বললেন মহারাষ্ট্রে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।

আমির খান বলে গেলেন নিজেকে নিয়ে যেমন, নিজের পরিবার ও সন্তানদের নিয়েও একই রকম অকপটে। 

প্রশ্ন: সিক্রেট সুপারস্টার ছবির চরিত্র শক্তি কুমারের জন্য নিজেকে আপনি কীভাবে প্রস্তুত করলেন?

আমির খান: দেখুন, চিত্রনাট্য যখন ভালো হয়, তখন অভিনেতার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। চিত্রনাট্যই পরিষ্কার করে দেয় চরিত্রটা সম্পর্কে। আর আউটপুট তখনই ভালো আসবে, যখন ইনপুট ভালো হবে। এ জন্য আমি প্রচুর বইও পড়ি। শেষ পাঁচ-ছয় বছর আমি নানা রকম মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছি, মিশেছিও। সেটি সম্ভব হয়েছে সত্যমেব জয়তের জন্য। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি। অনেক কিছু শিখেছি। এখন মহারাষ্ট্রে ‘পানি ফাউন্ডেশন’ নিয়ে কাজ করছি। মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত গ্রামে তার জন্য যাচ্ছি। আর এখানেও নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসছি। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে এগুলোই আমার কাছে উপাদান। এসব আপনা থেকেই আমার মধ্যে চলে আসে। আমি যে রকম সুযোগ পেয়েছি, তা সাধারণত অন্য অভিনেতারা পান না। এ ক্ষেত্রে আমি খুব ভাগ্যবান। সত্যি বলতে কি, আমাদের অর্থাৎ তারকাদের নিজেদের রক্ষা করতেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে একটি অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখতে হয়। তা না হলে আমরা বাঁচতে পারব না।

প্রশ্ন: আপনি আপনার নিজের সিক্রেট, মানে গোপন কথা কাকে বলেন? ডায়েরি লেখেন নাকি?

আমির: না, না। ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই আমার। তবে কয়েকজন মানুষ আছে, যাদের সঙ্গে আমি আমার গোপন কথা বলি। যেমন আমার স্ত্রী কিরণ। আমার তুতোদিদি নুজহাত, মানে অভিনেতা ইমরান খানের মা। ছোটবেলা থেকেই ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই গভীর। আর আমার বন্ধু সত্যার (সত্যজিৎ ভাটকল) সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করি। সত্যা সত্যমেব জয়তের পরিচালক। এখন সে ‘পানি ফাউন্ডেশন’-এর সিইও। এই তিন-চারজন মানুষ আমার খুব কাছের।

প্রশ্ন: সম্প্রতি কোনো বড় তারকার ছবি সেভাবে বক্স অফিসে সাড়া পায়নি। এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?

আমির: আমার মনে হয়, এর দায়ভার কোনোভাবেই তারকার ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। কারণ, তারকার জন্য কোনো ছবি হিট বা ফ্লপ কোনোটাই হয় না। তারকার কারণে কখনো কোনো সিনেমা চলে না। আমার পিকে ছবিটা যে হিট করেছে, এর কারণ কি আমি? একদমই নয়। ছবিটা নিজেই ভালো। এর কৃতিত্ব ছবিটির পরিচালক রাজু মানে রাজকুমার হিরানির প্রাপ্য। একটা ছবি ভালো বা খারাপ হওয়ার সব দায়দায়িত্ব ছবির পরিচালক ও গল্পকারের। আমরা তারকারা হয়তো ছবিটি মুক্তি পাওয়ার সময়টাতে দর্শক টানতে পারি। আর ছবিটিতে নিজেদের সৃষ্টিশীলতাটুকু দিতে পারি। কিন্তু ছবি হিট করাতে পারি না। দঙ্গল ছবিটা যে ভালো হয়েছে, সেটা অবশ্যই নীতেশ তিওয়ারির জন্য। ছবির সাফল্যের কৃতিত্ব আমি তাকেই দেব। আবার দঙ্গল যদি ফ্লপ হতো, তার দায়ও আমি নীতেশের ওপরই চাপাতাম।

প্রশ্ন: আপনারা তিন খান ২৫ বছর ধরে বলিউড রীতিমতো শাসন করছেন। এর রহস্য কী?

আমির: এর কারণ আমি আজও খুঁজে পাইনি। কোন তারকাকে কোন মানুষের কেন ভালো লেগে যায়, তা কারও জানা নেই। স্টারডম ব্যাপারটাই রহস্যময়। এমন অনেক তারকা আছেন, যাঁর কোনো যোগ্যতাই নেই, অথচ তিনি তারকা। এমনও অনেকে আছেন, যিনি প্রচলিত অর্থে সুন্দর নন, তারপরও তারকা। তাই স্টারডম কীভাবে বজায় রাখা যায়, সেটা বলা কঠিন। আগামী বছর বলিউডে আমার ৩০ বছর হবে। এত দিন কীভাবে টিকে আছি, সেটা আমি নিজেও জানি না। তেমনি শাহরুখ বা সালমানও নিশ্চয় জানে না, তাদের এই টিকে থাকার রহস্য।

প্রশ্ন: থাগস অব হিন্দোস্তান ছবিতে আপনি অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁর দ্বারা আপনি অনুপ্রাণিত। কী রকম অভিজ্ঞতা?

আমির: অমিতজির সঙ্গে কাজ করা এক বিশাল শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। উনি একটি প্রতিভার শক্তিকেন্দ্র। অমিতজিকে কাছ থেকে দেখে অনেক কিছু শিখেছি। উনি সহ-অভিনেতা হিসেবে দুর্দান্ত। অসম্ভব পরিশ্রমী। নিজের চরিত্রের জন্য অসম্ভব আবেগ বিনিয়োগ করেন। খুবই মগ্ন হয়ে থাকেন তাঁর চরিত্র নিয়ে। অমিতজির থেকে আমি অনেক কিছু পেয়েছি।

প্রশ্ন: শুটিং চলাকালীন বিরতির সময় অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কী ধরনের কথাবার্তা হতো?

আমির: আমরা প্রচুর আড্ডা মারতাম। অমিতজির কাছ থেকে এমন অনেক গল্প শুনেছি, যা উনি সচরাচর কাউকে বলেন না। আমার কিন্তু জানার কৌতূহল প্রচণ্ড। খুব মজা লাগত অমিতজির সঙ্গে আড্ডা মারতে। উনি সংগীত খুব ভালোবাসেন। মাল্টায় শুটিং চলাকালে একবার তাঁকে নিয়ে হেঁটে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। প্রথমে অমিতজি একটু দ্বিধায় ছিলেন গাড়ি ছাড়া যাবেন কি না, তা নিয়ে। এমনকি সঙ্গে আমরা কোনো নিরাপত্তাও নিইনি।

প্রশ্ন: অমিতজির সঙ্গে কী সিনেমা দেখলেন?

আমির: (একটু ভেবে) যত দূর মনে পড়ছে ওয়ান্ডার উওম্যান

প্রশ্ন: আচ্ছা, বাবা হিসেবে আপনি কেমন?

আমির: আমি কখনোই কঠোর বাবা নই। তবে আজকাল যে মা-বাবারা সব বাচ্চার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেন, তাতে আমার প্রবল আপত্তি আছে। বাচ্চাদের মাঠে গিয়ে খেলা উচিত। আজাদ রোজ বিকেলে ক্রিকেট-ফুটবল খেলে। বাড়িতে ঢুকতেই চায় না। আমার বড় ছেলে জুনায়েদ যখন আমার কাছে মোবাইল চাইল, তাকে বলেছিলাম, ‘আগে নিজে মোবাইলের বিল দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করো, তারপর মোবাইল কিনবে।’ জুনায়েদ যখন কলেজে গেল, তখন তাকে প্রথম মোবাইল কিনে দিই। আমি তো তা-ও দিতাম না। রীনার (প্রথম স্ত্রী রীনা খান) জন্য বাধ্য হয়ে দিয়েছি। মায়েদের মন একটু নরম হয় তো। তারপরও কিন্তু জুনায়েদকে স্মার্টফোন কিনে দিইনি। এখন আমি নিয়ম করে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত আজাদের সঙ্গে সময় কাটাই। দুই ঘণ্টা শুধু আজাদের জন্য। আমি আর কিরণ আজাদকে গল্প পড়ে শোনাই। আটটার পরে ও ঘুমিয়ে পড়ে।

প্রশ্ন: যা হোক, ছবির কাজ শেষে কি আপনি টিভিতে ফিরছেন? সত্যমেব জয়তে আবার কবে টিভির পর্দায় আসবে?

আমির: সত্যমেব জয়তের পুরো টিম এখন ‘পানি ফাউন্ডেশন’-এর কাজে ব্যস্ত। আমাদের এই মিশনটা শেষ হলে আবার সত্যমেব জয়তে শুরু হবে বলে আশা করি।

প্রশ্ন: সত্যমেব জয়তের পর আপনি ‘পানি ফাউন্ডেশন’ নিয়ে কাজ করে চলেছেন। এই উদ্যোগ কত দূর এগোল?

আমির: এটা আমাদের একটা নতুন উদ্যোগ ও নিরীক্ষা। ‘পানি ফাউন্ডেশন’-এর কাজ খুব ভালো গতিতে এগোচ্ছে। আমরা কাজ করছি মহারাষ্ট্রে। প্রথম বছর আমরা তিনটি এবং দ্বিতীয় বছর ৩০টি তালুকার ওপর কাজ করেছি। এ বছর ৯০ থেকে ১০০ তালুকার ওপর কাজ করার ইচ্ছা আছে। এই উদ্যোগে প্রচুর মারাঠি অভিনেতাকে আমাদের পাশে পেয়েছি। তাঁরা নানাভাবে আমাদের সহযোগিতা করছেন। কোনো কোনো অভিনেতা ‘পানি ফাউন্ডেশন’ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসছেন। কেউ কেউ আবার গ্রামে গিয়ে এ কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

প্রশ্ন: এই কাজটা তো একদমই ব্যতিক্রমী। এই উদ্যোগ নিয়ে কি কোনো ছবি বানাবেন, সবাই যাতে জানতে পারে?

আমির: একদমই না। এ নিয়ে আমি কোনো ছবি বানানোর পক্ষপাতী নই। কাজটি আমি নিজের প্রচারের জন্য করছি না। আমি বরং এই কাজের প্রচার চাই। এই কর্মকাণ্ডে আমরা আরও গ্রামকে যুক্ত করতে চাই। এখন যেহেতু কেবল মহারাষ্ট্রে কাজ করছি, তাই মারাঠি চ্যানেল ছাড়া অন্য কাউকে এ নিয়ে কোনো সাক্ষাৎকার দিইনি। ‘পানি ফাউন্ডেশন’ নিয়ে জাতীয় চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেওয়ারও অনেক অনুরোধ এসেছিল। কিন্তু আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। জাতীয় চ্যানেলে তো এ নিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। আমি কথা বলতে চাই যে রাজ্যে কাজ করছি, সেখানকার মানুষের সঙ্গে। আর তার জন্য দরকার স্থানীয় চ্যানেল। মহারাষ্ট্র বিশাল রাজ্য। প্রথমে এই রাজ্যে ভালোভাবে কাজ করি, তারপর অন্য রাজ্যের দিকে এগোব।

প্রশ্ন: নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আপনি যুক্ত। ইতিমধ্যে অনেকে আপনাকে রোলমডেল হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। অভিনেতা কমল হাসান সম্প্রতি রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আপনারও কি সে রকম কোনো ইচ্ছা আছে?

আমির: রাজনীতিতে যাওয়ার একদমই কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি যে পেশায় আছি, তাতেই খুশি। আমি আমার পেশাকে অসম্ভব ভালোবাসি। তা ছাড়া আমি এ-ও মনে করি না যে সামাজিক কাজ করার জন্য রাজনীতিতে আসতেই হবে। নিজের কাজের ক্ষেত্রে থেকেও সামাজিক দায় পালন করা সম্ভব। তাই আমি জীবনেও রাজনীতিতে যাব না।