সরাসরি গানের অনুষ্ঠানেও লেগেছে বাণিজ্যের ছোঁয়া

‘মিউজিক স্টেশন’ অনুষ্ঠানে গাইছেন শিল্পী সুজন আরিফ ও আয়েশা মৌসুমি
‘মিউজিক স্টেশন’ অনুষ্ঠানে গাইছেন শিল্পী সুজন আরিফ ও আয়েশা মৌসুমি

এই মুহূর্তে টিভি চ্যানেলগুলোতে চলছে সরাসরি গানের অনুষ্ঠানের রমরমা ভাব। আর সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে চ্যানেলগুলোর বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো কোনো চ্যানেল একই দিনে সকাল-সন্ধ্যা আয়োজন করছে এমন অনুষ্ঠান। সেখানে অংশ নিচ্ছে কিছু খ্যাত-অখ্যাত নবীন মুখ। ঘুরেফিরে মাত্র কয়েকজন। কম পয়সায়, সহজে এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগকে তারা ব্যবহার করছে আরও সহজতর উপায়ে। অথচ ইচ্ছা ও চেষ্টা থাকলে তারা এখানে ডেকে আনতে পারত খ্যাতিমান ও সাধক শিল্পীদের। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধক গুণীদের। তাহলে এসব অনুষ্ঠান হতে পারত বৈচিত্র্যময়, হতে পারত নবীন-প্রবীণের মেলবন্ধন। কিন্তু তা হচ্ছে না।

গত ১২ অক্টোবর রাত ১১টায় শিল্পী লিজার উপস্থাপনায় আরটিভিতে প্রচারিত হলো সরাসরি গানের অনুষ্ঠান ‘মিউজিক স্টেশন’। এখানে শিল্পী ছিলেন সুজন আরিফ ও আয়েশা মৌসুমি। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে গান করেছেন তাঁরা এবং দুজনই গান করেছেন দাঁড়িয়ে। সুরের সঙ্গে শরীরকে ব্যবহার করার জন্যই বোধ হয় দাঁড়িয়ে গান করেন। আমাদের আবহমান বাংলা গানের যে বৈঠকি মেজাজ, তা তাঁদের পরিবেশনায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

দুজনই গান করেছেন ড্রামস, কিবোর্ড ও গিটারের সঙ্গে। বিভিন্ন ধারার গান করেছেন তাঁরা এবং অধিকাংশই গেয়েছেন অন্যের জনপ্রিয় গান। যেমন আরিফ গেয়েছেন ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘তুমি আমার জান রে বন্ধু’; মৌসুমি গেয়েছেন ‘সময় গেলে সাধন হবে না (লালন গীতি)’, ‘ও আমার বন্ধু গো, চিরসাথি পথচলার’ ইত্যাদি। তাঁদের কণ্ঠ-সুর নিয়ে এবার কিছু বলতে চাই না। তাঁদের সামগ্রিক পরিবেশনার মধ্যে একটি বিষয় লক্ষণীয় ছিল, তা হলো আসর মাতানো। নেচে-গেয়ে তাঁরা আসর মাতানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি মৌসুমি যে পোশাকটি পরেছেন, সেটিও সংগীতশিল্পীর মতো মনে হয়নি, জাদুশিল্পীর মতো মনে হয়েছে। তাঁরা কতটা সফল হয়েছেন, জানি না। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, অনুষ্ঠানে দর্শকদের সরাসরি ফোন করার সুযোগ ছিল, কিন্তু কেউই ফোন করেনি।

পরদিন শুক্রবার ১৩ অক্টোবর সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে লুইপার উপস্থাপনায় এনটিভিতে প্রচারিত হলো আরেকটি সরাসরি গানের অনুষ্ঠান ‘ছুটির দিনের গান’। এখানে শিল্পী ছিলেন লিজা। আজ আমরা তাঁর গান নিয়ে নয়, কথা বলব অন্য বিষয়ে।

আগের দিন লিজা ছিলেন উপস্থাপক, পরদিন তিনিই আবার গায়ক। চ্যানেলগুলো এখন এভাবেই গান ও উপস্থাপনা—দুটোই চালিয়ে নিচ্ছে এসব তরুণ শিল্পীদের দিয়ে। এটিও সম্ভবত তাদের বাণিজ্যিক চিন্তাচেতনারই প্রতিফলন। অথচ আমরা জানি, একদা গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য গুণী ও বিদগ্ধজনদের খুঁজে আনা হতো। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু আবু হেনা মোস্তফা কামালকে বিটিভি একদা বিমানভাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে নিয়মিত ডেকে আনত গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য। আসতেন হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। শিল্পীদের মধ্যেও আমরা বিদগ্ধ উপস্থাপক পেয়েছি, যেমন মোস্তাফা জামান আব্বাসী, আজাদ রহমান, সৈয়দ আব্দুল হাদী প্রমুখ।

বর্তমানে চ্যানেলগুলো যদি নবীন শিল্পীদের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য প্রবীণ বিদগ্ধ শিল্পীদেরও ডেকে আনে, আমাদের ধারণা, তাতে দর্শকেরাও আনন্দিত হবে। হবে নবীন-প্রবীণের মেলবন্ধন। আর সেই সঙ্গেই সেসব অনুষ্ঠানে অনেকটা অবচেতনেই ঘটবে প্রবীণের কাছে নবীনের দায়বদ্ধতা।

আজ আমরা আলোচনা শেষ করব বিটিভির এ সপ্তাহের নাটক দিয়ে। ১৪ অক্টোবর শনিবার রাত ৯টা ১০ মিনিটে বিটিভিতে প্রচারিত হলো এ সপ্তাহের নাটক একজন শিক্ষক। রচনা ড. পিয়ার মোহাম্মদ ও প্রযোজনা ঈমাম হোসাইন।

শিক্ষকদের নীতি, আদর্শ ও চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে অনেক নাটক-সিনেমা হয়েছে, সেদিক থেকে বিষয়টি একেবারেই গতানুগতিক। গল্প ও নির্মাণশৈলী দিয়ে নাট্যকার ও নির্মাতা কেউই এটিকে ব্যতিক্রমী করে তুলতে পারেননি। বরং বলা যায়, নাটকটি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সরকারের গ্রামোন্নয়ন ও সচেতনতামূলক একটি জীবন্তিকা দেখছি।

নাটকের কিছু অসংগতি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। মাস্টারের ছেলে জামাল খেতে বসে ভালো তরকারি না পেয়ে থালা ছুড়ে ফেলে গিয়ে পড়ালেখা ছেড়ে আরেকজন শিক্ষকের সহায়তায় চোরাকারবারি হলো। যেভাবে এটি দেখানো হয়েছে, তা অবাস্তব। আবার মাস্টারের একজন সহকর্মী তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, তাঁর ছেলেকে চোরাকারবারি বানাচ্ছে, কিন্তু কেন? তার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ দেখানো হয়নি। এ ছাড়া অত বড় স্কুল দেখানো হয়েছে, সেখানে এত ঘটনা ঘটছে, অথচ শিক্ষক দেখানো হয়েছে মাত্র চারজন। ছাত্রছাত্রীদের কোনো ভূমিকা দেখানো হয়নি, ছাত্রছাত্রীই দেখানো হয়নি। শুধু শুরুতে টোকাই গোছের কয়েকজনকে দেখানো হয়েছে মাস্টারের সঙ্গে কাগজ কুড়াচ্ছে। এই। স্কুল ও মাস্টারকে নিয়ে নাটক, অথচ সেখানে স্কুলের বাস্তবতা নেই, ছাত্রছাত্রী নেই, এটা কীভাবে সম্ভব।

শেষে প্রতিবাদী গ্রামবাসী হিসেবে যাদের দেখানো হয়েছে, তা বড়ই বেমানান। আবার সেই গ্রামবাসীদের এক ধমকেই চেয়ারম্যান ও হেডমাস্টারের মতো মানুষদের আত্মসমর্পণ ও সবার সামনে মাস্টারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, এ কেবল বিটিভির নাটকেই সম্ভব, বাস্তবে নয়। এ ছাড়া নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দৃশ্য যেন দর্শক আগে থেকেই বুঝতে পারছিলেন, এরপর কী ঘটবে এবং তারপর কী ঘটবে। সব যেন সাজানো। আর চিত্রনাট্য ও নির্মাণ সম্পর্কে বললে বলতে হয়, যতটা দুর্বল চিত্রনাট্য, তার দ্বিগুণ দুর্বল সংলাপ এবং তার চতুর্গুণ দুর্বল নির্মাণ। ‘এ সপ্তাহের নাটক’ বিটিভির এক ঐতিহ্যবাহী নাম। নামটির মর্যাদা রক্ষার জন্য কর্তৃপক্ষের কিছু ভাবা উচিত।

শেষে দুটি প্রশংসাবাক্য। এক. বিটিভির গতানুগতিক সেট থেকে বেরিয়ে নাটকটির নির্মাণ। দুই. ততোধিক গতানুগতিক ও বস্তাপচা প্রেমকাহিনি না দেখানো।