হুমায়ূন আহমেদ ও 'ডুব' নিয়ে খোলামেলা কথা বললেন ফারুকী

>
ডুব ছবির একটি দৃশ্য
ডুব ছবির একটি দৃশ্য
আগামী শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত চলচ্চিত্র ডুব। এই ছবি নিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই পরিচালক। তাঁর পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি থাকছে কাল বৃহস্পতিবারের ক্রোড়পত্র ‘আনন্দ’-তে। আলাপে ফারুকী জানিয়েছেন, বাস্তব জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তিনি ছবিটি বানিয়েছেন। কিন্তু সেটা কারও জীবনভিত্তিক ছবি নয়। একই সঙ্গে তিনি খোলামেলা সব কথা বলেছেন হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর প্রভাব প্রসঙ্গে। রাসেল মাহ্‌মুদ–এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একটি অংশ আজ দেওয়া হলো।

উত্তর: দেখেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাদের কালের সবচেয়ে বড় নায়ক। আমাদের বড় হওয়ার কাল আর তাঁর পল্লবিত হওয়ার কাল হাত-ধরাধরি করে চলেছে। তিনি মারা যাওয়ার খবর যখন আমি জানি, তখন কোরিয়ার সিউলে একটা রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন আমাদের শব্দ প্রকৌশলী রিপন নাথ এবং টেলিভিশন ছবির অভিনেতা জব্বার। সেখানে টেলিভিশন ছবির পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ করছিলাম। আমি পাবলিক প্লেসে আবেগ দেখানোর লোক নই। কিন্তু খবরটা জানার পর আমার চোখ ভিজে উঠেছিল। সিউলে তখন বর্ষাকাল, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। রেস্তোরাঁর কাচে পানি, আমার চোখ ঘোলা, কাচ ঘোলা—অদ্ভুত বিষণ্ন সময়।

সিউল থেকে দেড় শ মাইল দূরে একটা জায়গায় থাকতাম। প্রতিদিন গাড়িতে করে যাতায়াতের সময় আমাদের গাড়িতে বিটলসের ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস’ গানটা বাজত। আমি শুনতে পেতাম, ‘হোয়াইল হিজ পেন জেন্টলি উইপস’। যখন তাঁর কলম নীরবে কাঁদছে, তখন তাঁর দাফন নিয়ে চলছিল দুঃখজনক, হৃদয়বিদারক নাটক। এ ঘটনা আমার ভেতরে তীব্রভাবে নাড়া দেয়, আমাদের সবাইকেই নাড়া দিয়েছিল।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

হুমায়ূন আহমেদ ও আমি একই শহরে একই সময়ে বাস করেছি। কিন্তু কখনো মনে হয়নি, যাই, একটু দেখা করে আসি। তাঁর প্রভাব যে আমাদের ভেতরে কীভাবে ছিল, সেটা আগে কখনো তলিয়ে দেখিনি। গল্প-উপন্যাস পড়েছি, ভালো লেগেছে, ব্যস। তিনি অলক্ষ্যে আমাদের ভেতরে যে কীভাবে গেড়ে বসেছেন, সেটা বুঝলাম তাঁর মৃত্যুর পর, সিউলে বসে যখন তাঁর মৃত্যু–পরবর্তী নানা ঘটনা অবলোকন করছিলাম। তখন যা কিছু ঘটেছে, তার সবই জনগণ দেখেছে। এর কোনো কিছুই তো গোপন নয়। তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারও তো গোপন নয়। জনপরিসরে থাকা বা না-থাকা, যেকোনো বিষয়কে ভিত্তি করে যে কেউই গল্প ফাঁদতে পারে এবং সেই গল্পকে সত্য হয়ে উঠতে হয় না। গল্প বাস্তবের জগৎ থেকে অনুপ্রেরণা নেয় বটে, কিন্তু বাস্তব পুনর্নির্মাণের কোনো দায় সে নেয় না। যেমন দায় নেয়নি জঁ লুক গদারের জীবন নিয়ে বানানো রিডাউটেবল বা সত্যজিৎ রায়ের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত ঋতুপর্ণ ঘোষের আবহমান বা আমার নিজের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত টেলিভিশন! এমনকি বাস্তব চরিত্রের নামধাম উল্লেখ করে লেখা উপন্যাসেও বানোয়াট গল্পই লেখা হয়। সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার উদাহরণ আছে। এমনকি হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল-এর উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। সেখানে কি তিনি সত্য তথ্যের নিশ্চয়তা দিয়েছেন? যেমন তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর তোফায়েল আহমেদ ঝিম মেরে ছিলেন। এখন তোফায়েল সাহেব যদি বলেন, ‘ভাই, আপনি কোত্থেকে পেলেন আমি ঝিমাচ্ছিলাম? আমি তো অস্থির পায়চারি করছিলাম!’ তাহলে এটার কী উত্তর হবে বা তোফায়েল সাহেব যদি বলেন, ‘আপনি যে আমার নাম ব্যবহার করে গল্প লিখলেন, আমার বা আমার পরিবারের অনুমতি নিয়েছেন?’ আর আমাদের ছবির ক্ষেত্রে যদি বলি, আমরা তো হুমায়ূন আহমেদ বা তাঁর পরিবারের কারও নামই ব্যবহার করিনি, কোথাও জীবনী দাবি করিনি। আমরা প্রথম থেকেই বলে এসেছি, এটা কারও না কারও জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে, সিউলের সেই বৃষ্টির দিনগুলোর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে, বিটলসের গান থেকেও অনুপ্রেরণা নিতে পারে। অনুপ্রেরণা মূল বিষয় নয়, বিষয় হলো গল্পের মানুষগুলোর বেদনা, নীরবতা, হাহাকার আমি কীভাবে এঁকেছি।