বাবার সাহসেই পথচলা বিউটির

বিউটি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
বিউটি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

সময়টা ছিল ২০০৫ সাল। ‘ক্লোজ আপ ওয়ান-তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার প্রথম মৌসুমের অডিশন পর্ব শুরু হয়েছে। ফরিদপুর জোনের অডিশন পর্বে গান গাইতে এলেন এক মেয়ে। গোলাপি আর সাদার মিশেলে খুব সাধারণ পোশাক পরা সেই মেয়ের থেকে বিচারকেরা সেদিন খুব বেশি কিছু আশা করেননি। কিন্তু সদ্য নিম্নমাধ্যমিক পাস করা সেই শান্ত, সাধারণ মেয়েটির কণ্ঠেই সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রতিযোগিতার প্রত্যেক বিচারক। তাঁর গান শুনে তাক লেগে গিয়েছিলেন টিভি সেটের সামনে বসা দর্শক। সেদিন থেকে তাঁর নাম হলো ‘লালন-কন্যা’। এই লালন-কন্যার নাম বিউটি। চুয়াডাঙ্গার জেলার ছোট একটি গ্রাম মোড়ভাঙ্গা থেকে উঠে আসা এই শিল্পীর ‘লালন-কন্যা’ হয়ে ওঠার পেছনের গল্পটা কিন্তু মোটেও সাধারণ নয়। এর পেছনে আছে অনেক সংগ্রাম আর সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সামনের এগোনোর সাহস।

বিউটির বাবা মজিবর রহমানের গানের প্রতি দারুণ ঝোঁক। কেবল ভালোবাসার জোরেই ওস্তাদের কাছ থেকে গান শিখতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোনো দিন মঞ্চে পরিবেশন করেননি। ইচ্ছা ছিল তাঁর একজন সন্তানকে শিল্পী বানাবেন। তিন মেয়ে, দুই ছেলের মধ্যে কমবেশি সবাই গান করতেন। কিন্তু বাবার মতো সংগীতকে আপন করে নিয়েছিলেন একমাত্র বিউটি।

চার বছর বয়স থেকে বিউটি বাবার কাছেই লালনগীতির তালিম নিয়েছেন। একটু বড় হওয়ার পর এলাকার স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানগুলোতে শিশুশিল্পী হিসেবে গান গাইতে যেতেন। ধীরে ধীরে তাঁর গায়কির খ্যাতি গোটা চুয়াডাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। বিউটির ভাষায়, ‘তত দিনে সবাই জেনে গেছে বিউটি নামের ছোট একটা মেয়ে লালনের গান করে।’

বাবার সঙ্গে বিউটি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
বাবার সঙ্গে বিউটি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

নিজের গ্রামের লোকেরা বিউটির গান গাওয়াটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। তাদের কাছে এটি ছিল গর্হিত কাজ। আর বাবার ইচ্ছায় মেয়ে গান করছে, এটি তো রীতিমতো ‘ভয়াবহ অপরাধ’! এ জন্য মানুষের অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে বিউটির বাবাকে। পরিবারের অনেক বিপদে-আপদে গ্রামের মানুষকে পাশে পাননি শুধু এ কারণে। কিন্তু বিউটি ও তাঁর বাবা দমে যাননি। সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে মজিবর রহমান মেয়েকে নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কোথাও কোনো গানের অনুষ্ঠান বা প্রতিযোগিতা হলেই বিউটিকে তিনি আগে পাঠিয়ে দিতেন। নিজে পরে রওনা হতেন, যেন গ্রামবাসীর চোখে না পড়েন।

বিউটি সব প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়ে বাবার উজ্জ্বল করতেন। মনে শুধু একটাই আফসোস ছিল। বিউটি বলেন, ‘সব জায়গা থেকে প্রথম হয়ে গিয়ে ঢাকায় গিয়েই হেরে যেতাম। সেখানে খুব পক্ষপাতিত্ব হতো।’ অনেক ভালো গেয়েও ক্ষমতাবানদের কাছে গ্রামের মেয়ে বিউটি তখন পাত্তাই পেতেন না। তবু গান গাওয়ার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করতেন না এই শিল্পী। কারণ, পুরস্কার বা তারকাখ্যাতির লোভ তাঁর ছিল না। গান শুধু ভালোবেসেই গেয়ে যেতে চান।

প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে অতীতের গল্প বলতে গিয়ে বিউটি বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। এক নিশ্বাসে বলে যান তাঁর আর বাবার সাহসিকতার গল্প। ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর গল্পটা বলেন। বিউটি শুরু করেন, ‘আমাদের গ্রামে তখন ডিশ ছিল না। যে কয়জনের বাড়িতে ডিশ ছিল, সেখানে বিটিভি ছাড়া আর কোনো চ্যানেল দেখা যেত না। ক্লোজআপ ওয়ানের একটা বিজ্ঞাপন আমি টিভিতে কয়েকবার দেখেছিলাম, কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনের অর্থ বুঝিনি। এক বন্ধু একদিন আমার কাছে একটি প্রথম আলো পত্রিকা নিয়ে এল। সেখান থেকেই প্রতিযোগিতার সব নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারি। এ জন্য প্রথম আলোর প্রতি আমি সব সময় কৃতজ্ঞ।’

নিয়ম জানা হলেও বিউটি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ পাননি। মনে করেছিলেন, এবারও হয়তো ঢাকায় গিয়ে ছিটকে পড়েন। কিন্তু বাবা আর বড় বোনের অনুরোধে রেজিস্ট্রেশন করেন। সেই নাম লেখানোর গল্পও অনেক লম্বা। নিজেদের ফোন ছিল না। বাজারে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর রেজিস্ট্রেশন করতে পেরেছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নাম থাকার কথা খুলনা জোনে। কিন্তু সেই বিভাগের রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে আয়োজকেরা ফরিদপুরে রেজিস্ট্রেশনে পরামর্শ দেন।

ফরিদপুরে অডিশন দিতে গিয়ে বিউটি তো অবাক। এত বড় প্রতিযোগিতা! এটা তিনি আগে বুঝতে পারেননি। দেখতে পেলেন অন্যান্য প্রতিযোগী সাজগোজ করে এসেছে। কেউ কেউ বড় বড় গাড়ি থেকে নামছে। এত দিন ধরে গান গেয়ে যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলেন, এসব দেখে তা পানির মতো গলে যায়। বিউটির ধারণা ছিল, এখানে সব ধনীর ছেলেমেয়ে এসেছে, তারা না জানি কত বড় ওস্তাদের কাছে গান শিখেছে। আর বিউটির গানের শিক্ষা তো সেই গ্রামের ভেতরে সীমাবদ্ধ। তিনি কি এখানে টিকতে পারবেন? এই ভেবে, বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করতে কাঁদতে লাগলেন। বাবা তখন মেয়েকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘প্রতিভার সঙ্গে ধনী-গরিবের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিভা থাকলে তুমি যতই দরিদ্র হও, কেউ তোমাকে আটকাতে পারবে না।’ এই একটি কথা, একটি লাইন বিউটির ভেতরে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিল। পরের গল্পগুলো সবারই জানা।

বাবার কাছ থেকে পাওয়া সাহসে বিউটি ক্লোজআপ ওয়ান আসরের প্রথম মৌসুমে শীর্ষ তিনে জায়গা করে নেন। বিউটি সেই ২০০৫ সালের স্মৃতি মনে করে বলেন, ‘আমি আমার অতীতকে শ্রদ্ধা করি। আমার বাবা একজন কৃষিজীবী । আমার সংগীতজীবনের যাত্রা অনেক জটিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার বাবার কারণে তা হয়নি। আমাকে গান শেখানোর জন্য সব সংগ্রাম তিনিই করেছেন। পথের কাঁটা নিজের হাতে সরিয়ে আমার জন্য তৈরি করেছেন একটি মসৃণ পথ।’

যাঁরা একসময় গান গাওয়ার জন্য বিউটির পরিবারকে অপমান করেছিলেন, এখন তাঁরাই বিউটিকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেন। বিউটি এখন মোড়ভাঙ্গা গ্রামের গর্ব। বিউটি গান নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন, তা নিয়েই আছেন। পড়াশোনাও করেছেন গান নিয়ে। ইদানীং একমাত্র সন্তান রায়াতকে নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত থাকায় দেশের বাইরের কয়েকটি অনুষ্ঠানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ জন্য অবশ্য তাঁর কোনো আফসোস নেই। বললেন, ‘ভালো শিল্পীর পাশাপাশি আমি একজন ভালো মা হতে চাই।’ আর চান লালন সাঁইয়ের ১০০টি গান নিয়ে একটি অ্যালবাম করতে। কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, এই অ্যালবাম তিনি নিজের কাছে আর্কাইভ হিসেবে রাখতে চান।