'পৃথিবী ফুল হলে কবিতা তার সৌরভ'

বাংলা ​একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে গতকাল লিট ফেস্টের উদ্বোধন করেন সিরিয়ার কবি অ্যাডোনিস (্বাঁ থেকে চতুর্থ)। সঙ্গে আয়োজক ও অতিথিরা l ছবি: প্রথম আলো
বাংলা ​একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে গতকাল লিট ফেস্টের উদ্বোধন করেন সিরিয়ার কবি অ্যাডোনিস (্বাঁ থেকে চতুর্থ)। সঙ্গে আয়োজক ও অতিথিরা l ছবি: প্রথম আলো

চোখে-মুখে অদ্ভুত এক জেল্লা, অথচ দেখতে সাধারণ। সৌম্যকান্তি চেহারার এই কবি এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের মনোনয়নের ছোট তালিকায় এসেছেন। পৈতৃক নাম আলী আহমাদ সা’ইদ এসবার। পরিচিত অ্যাডোনিস নামে। গতকাল সকালে বাংলা একাডেমিতে তিন দিনব্যাপী ঢাকা লিট ফেস্টের সপ্তম আসরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন বর্তমানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই কবি।

উদ্বোধনের পরের অধিবেশনেই বাংলাদেশি কবি, প্রাবন্ধিক কায়সার হকের সঙ্গে এক আড্ডায় বসেন অ্যাডোনিস। শুরুতেই প্রশ্ন ছিল, সিরিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে কীভাবে তিনি অ্যাডোনিস হলেন? অ্যাডোনিস বলেন, ১৯৩০ সালে তাঁর জন্ম। যে অজপাড়াগাঁয়ে তিনি জন্মেছিলেন, সেখানে কোনো স্কুল ছিল না। তাঁকে স্থানীয় মক্তবে পাঠানো হয় কোরআন ও আরবি শিক্ষার জন্য। একই সঙ্গে তাঁর বাবা বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁকে ছোটবেলা থেকেই পরিচয় করিয়েছিলেন। একসময় কবিতা তাঁকে পেয়ে বসল। তখন থেকেই কবিতা লেখা শুরু।

অ্যাডোনিস বলতে থাকেন, একবার সদ্য স্বাধীন সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি শুকরি আল-কুয়েতলি তাঁদের গ্রামে এলেন। তাঁর সামনে ১৪ বছর বয়সী কিশোর অ্যাডোনিস নিজের লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করে। কবিতা শুনে সিরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান এত খুশি হলেন! অ্যাডোনিসের একটি ইচ্ছা পূরণও করতে চান। কিশোর অ্যাডোনিস বলল, সে স্কুলে যেতে চায়। তরুণ কবির চাওয়া রাখলেন রাষ্ট্রপতি। মক্তব থেকে স্কুলে ভর্তি হলো অ্যাডোনিস। পরে তিনি ভর্তি হন দামাস্কাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সময় তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ ‘অপরাধে’ জেলে পাঠানো হয়।

পরে অ্যাডোনিস লেবাননের বৈরুতে চলে যান। অ্যাডোনিস বলেন, সেখানে আলী আহমাদ নামে নানা ম্যাগাজিনে তিনি লেখা পাঠাতে শুরু করলেন। কিন্তু কেউই তাঁর লেখা ছাপে না। একসময় তিনি নিজের নাম পাল্টে রাখলেন ‘অ্যাডোনিস’। গ্রিক দেবতা অ্যাডোনিস এমন নামকরণে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, সৌন্দর্য ও বাসনার দেবতা অ্যাডোনিসকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তাঁর প্রেমিকা প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি অ্যাডোনিসের রক্তের ওপর অমৃতের ধারা বইয়ে দেন। আর তা থেকে নতুন করে ফোটে ফুল।

সিরিয়ার কবি অ্যাডোনিসও তাই সম্পূর্ণ নতুন পরিচয়ে লেখা পাঠাতে থাকলেন। এবার সব ম্যাগাজিন তাঁর লেখা ছাপাল। অ্যাডোনিস বলেন, লেখা ছাপানোর পর তিনি সব সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করলেন। তাঁকে দেখে কেউই বিশ্বাস করতে চান না, তিনি অ্যাডোনিস। পরে রীতিমতো তাঁকে প্রমাণ দিতে হলো।

লেবাননের সাহিত্যিক মহলে খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন অ্যাডোনিস। তাঁর কাব্যভাষা লেবাননের কাব্যচর্চায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। পরে লেবানন থেকে ফ্রান্সে চলে যান অ্যাডোনিস। বর্তমানে প্যারিসে থাকেন এই কবি। অ্যাডোনিস বলেন, তাঁর আসলে দুই মা—গর্ভধারিণী মা ও কবিতা।

নিজের সারা জীবনের কাব্যচর্চার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, যে সাহিত্য ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু যে সাহিত্য প্রান্তিক, সেটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কবিতা তাঁর কাছে সুগন্ধির মতো। তিনি বলেন, পৃথিবী যদি ফুল হয়, তবে কবিতা তার সৌরভ।

অ্যাডোনিস বলেন, তিনি আজীবন রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে চেয়েছেন। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্ম ও রাজনীতি একসঙ্গে মিলিয়ে দিলে দুটোই দূষিত হয়। তিনি বলেন, ধর্মগ্রন্থগুলোকে আবার নতুন করে নানা দিক থেকে পাঠ করার প্রয়োজন আছে।

আরব বসন্তকে আমেরিকানদের তৈরি কৃত্রিম সংকট মনে করেন অ্যাডোনিস। বলেন, আরব বসন্ত আসলে আমেরিকার রাজনীতিবিদদের তৈরি, যেমন ওসামা বিন লাদেনকে তারা তৈরি করেছিল। তাদের জন্যই আজ লেবানন, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকের মতো দেশগুলো ধ্বংস হয়েছে।

এর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঢাকা লিট ফেস্টের তিন পরিচালক সাদাফ সায, আহসান আকবর ও কাজী আনিস আহমেদ। বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। বঙ্গবন্ধুর গ্রাফিক নভেল মুজিব-এর মোড়ক উন্মোচন করে উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। এ সময় আরও ছিলেন কবি অ্যাডোনিস ও বঙ্গবন্ধুর নাতি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।

আজ ও আগামীকালও এ সাহিত্য উৎসব চলবে। সকাল ৯টা থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত হবে বিভিন্ন অধিবেশন। এবার ৯০টি অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন ২৩টি দেশের ৭৫ জন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পী। বাংলাদেশ থেকে অংশ নিচ্ছেন ১৫০ জন। উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আছেন বুকারজয়ী নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক বেন ওকরি, ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিলডা সুইনটন, দুবার অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত চিত্রনাট্যকার ডেভিড হেয়ার, ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল।

লিট ফেস্টের আরও কিছু অনুষ্ঠান

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘মুজিব: টেকিং হিস্ট্রি টু দ্য নেক্সট জেনারেশন’ নামে গ্রাফিক নভেলা মুজিব নিয়ে আলোচনা হয়। এতে অংশ নেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী, কার্টুনিস্ট রাশাদ ইমাম তন্ময়, ব্রিটিশ সাহিত্য জার্নাল গ্রান্টার অনলাইন এডিটর লুক নেইমা, আরজু ইসমাইল এবং ভারতীয় সাহিত্যিক জেরি পিন্টো। বৈঠকি আড্ডার ঢঙেই উঠে আসে সুপারহিরোর অভাবের কথা। এটি তৈরি করার সময় কতটা সতর্ক হয়ে কাজ করতে হয়েছে, সে কথাও উঠে আসে। বইটির নাম ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ না হয়ে কেন মুজিব হলো, তা ব্যাখ্যা করা হয়। নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে কাজটি, তাদের কাছে যেন সহজবোধ্য হয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আসার আগে ইরেশ যাকেরের সঞ্চালনায় প্রাণবন্ত আলোচনা শুরু করেন ডেভিড হেয়ার। তিনি একাধারে চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, নাট্যকার এবং মঞ্চে নাট্যনির্দেশক। ‘স্টেজিং স্টোরি’ নামের আয়োজনে ডেভিড হেয়ার চলচ্চিত্র, শিল্প, সময় নিয়ে কথা বলার মধ্যে তাঁর নিজের জীবনও উঠে আসে। রসিকতা করে বলেন, ‘বাবার অনুপস্থিতিই আমাকে নাট্যকার বানিয়েছে।’ গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে নিজের বেড়ে ওঠার প্রসঙ্গ টেনে এনে তিনি সে সময়ের পরিবর্তমান সময়ের কথা উল্লেখ করেন। পড়ার অভ্যাসের ওপর তিনি জোর দেন। বারবার একটি বই পড়লে বইটি একটু একটু করে বোঝা যায়। প্রথম পাঠে হ্যামলেটের কাহিনিটাই শুধু মনে থাকবে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় পাঠে ধীরে ধীরে দ্বিধাদ্বন্দ্বে দোদুল্যমান হ্যামলেট এসে ধরা পড়বে। আসাদুজ্জামান নূর তাঁর মঞ্চনাটকে আসা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গ্রুপ থিয়েটার গড়ে ওঠার ইতিহাস জানান। রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে মৃদু রসিকতাও করেন। কেন তরুণেরা এখন আর আগের মতো মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী।

‘ম্যাজিক্যাল টেল’ ছিল বুকার পুরস্কারজয়ী বেন ওক্রিকে নিয়ে। অশোক ফেরির সঞ্চালনায় ওক্রি শোনান তাঁর লেখালেখির গল্প। অদ্ভুত এক গল্প বলেন তাঁর ম্যাজিক ল্যাম্প বইটি নিয়ে। তিনি পেইন্টিংয়ের সামনে বসে থাকেন। দিন যায়। বসে থাকেন। তারপর পেইন্টিংটাই তাঁর সঙ্গে কথা বলে। যেটুকু লেখার লিখে রেখে দেন বাক্সে। আবার দেখেন, আবার লেখেন। এভাবেই একসময় লেখাটা শেষ হয়। এই বইতে ২৫টি গল্প আছে, ২৫টি পেইন্টিংয়ের কাছ থেকে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। এই সেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বটি জমে ওঠে। ওক্রি বলেন, একটি লেখা শেষ করার জন্য সময় নিতে হয়। ধৈর্য ধরতে হয়। তবে যা মনে আসে, তা মাথায় রাখলে হবে না, লিখে রেখে দিতে হবে। পরে ওই লেখার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে পুরো গল্প।