নিত্যপুরাণ এর জয়ধ্বনি ও এক বাক্যে 'ভালো'

নিত্যপুরাণ নাটকের দৃশ্য
নিত্যপুরাণ নাটকের দৃশ্য

দৃশ্যমাধ্যমের যেকোনো পরিবেশনের ক্ষেত্রে ইউনিটি ও হারমনি যে মহাগুরুত্বপূর্ণ, বোধ করি সেটি নতুন করে বলে কান ঝালাপালা করা অর্থহীন। তবু এই অর্থহীন কাজটি করলাম। কারণ মাসুম রেজার রচনা ও নির্দেশনায় নিত্যপুরাণ নাটকটি পরিবেশনার রূপ-রস-গন্ধে যেমন ভালো লাগল, চোখ ভরিয়ে গেল, তেমনি এই অর্থহীন কান ঝালাপালা করার কাজটি করতে কিঞ্চিত প্ররোচিতও করল!

নিত্যপুরাণ কেমন লাগল?

সেদিন শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হল থেকে দেশ নাটকের এই নাটক দেখে বেরোতেই পরিচিতজনদের প্রশ্ন। জবাবে এক শব্দে বলেছিলাম, ভালো।

স্বীকার করতেই হবে, ভালো লাগার অনেক উপাদানই এই প্রযোজনায় বিদ্যমান। দেশ নাটকের দলপ্রধান ইশরাত নিশাতের ভাষায় এটি নিত্যপুরাণ-এর ‘পুনরায় জাগরণ’। নাটকটি প্রথম দফায় মঞ্চায়িত হয়েছিল ২০০১ সালে। তখন থেকে মানুষের মুখে মুখে নিত্যপুরাণ-এর জয়ধ্বনি। শুনেছি একলব্য চরিত্রে প্রয়াত অভিনেতা দীলিপ চক্রবর্তীর অনন্য অভিনয়ের কথাও। যেহেতু সেই দফায় প্রযোজনাটি দেখা হয়নি, ফলে আমাদের কাছে এই নিত্যপুরাণই সবেধন নীলমণি। নিত্যপুরাণ-এর এই প্রযোজনাই আমাদের ভালো লাগে, ক্ষেত্রবিশেষে মুগ্ধতাও জাগায় এবং কোনো নাটকের সফল হওয়ার পেছনে যে ইউনিটি ও হারমনি—এসবের একটা অলিখিত ব্যাপার কাজ করে, সে বিষয়টিও মাথায় ঘুরতে থাকে।

মহাভারতের একলব্যের আখ্যান নিয়ে নিত্যপুরাণ রচিত। এখানেও একলব্যের নিয়তি মহাভারতের মতো। পার্থক্য এই, মহাভারতে একলব্যের সঙ্গে দেখা হয় না দ্রৌপদীর। আর এই স্থলে দ্রৌপদী ও একলব্যের সাক্ষাৎই প্রযোজনাটিকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। নাট্যকারের ভাষ্যে, ‘মহাভারতে দ্রৌপদীর সঙ্গে একলব্যের সাক্ষাৎ হয় না। নিত্যপুরাণ-এ আমি তাদের দাঁড় করিয়েছি নারী ও নিন্মবর্গের স্বরূপ সন্ধানে।’

এই নাটকের কাহিনিতে কি তাহলে একলব্য আর দ্রৌপদীই মুখ্য? উত্তরে হ্যাঁ আর না দুই-ই বলা যায়। যে একলব্য নিন্মবর্গীয় ও অক্ষত্রিয় হওয়ার অপরাধে দ্রোণাচার্যের প্রতক্ষ শিক্ষা পাননি, দ্রোণাচার্যের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি এবং দ্রোণাচার্যকেই মান্য করেন গুরু হিসেবে। মহাভারতের এই কাহিনিরেখা নিত্যপুরাণ-এও আছে হুবহু। তবে এখানে নতুন যা দেখা গেল সেটা মৃগয়া পর্বে নতুন আখ্যানের বয়ান: মৃগয়ায় এসেছেন যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। এ সময় তাঁদের সঙ্গে দেখা হলো অজ্ঞাতকুলশীল একলব্যের। যুদ্ধবিদ্যায় একলব্যের পরদর্শিতা নজর এড়াল না পঞ্চপাণ্ডবের। এমনকি দ্রৌপদীর কুন্তল ভেদ করার বাজিতে হেরে তাঁর হাতে বন্দী হলেন পঞ্চপাণ্ডব। তাঁদের এখন হত্যা করা হবে­—শুরু হলো নাট্যোৎকণ্ঠা।

পঞ্চপাণ্ডবকে হত্যার জন্য একলব্যের কাছে বাণ আছে চারটি। এর অর্থ, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবেন পাঁচজনের যেকোনো একজন—কে তিনি? অবশেষে নির্ধারণের ভার পড়ল দ্রৌপদীর ওপর। ফলে অকুস্থলে দ্রৌপদীর প্রবেশ। কাকে সবচেয়ে ভালোবাসেন এই পাঞ্চালিকন্যা; অথবা পাঞ্চালিকন্যা দ্রৌপদীকে পঞ্চপাণ্ডবের কোনজন বেশি ভালোবাসেন—এমন প্রশ্ন ছুড়ে গোটা নাটকে যে নাটকীয়তা তৈরি করেন নাট্যকার, তা কেবল দর্শকের সামনে টান টান নাট্যমুহূর্তই দাখিল করে না, আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখিও দাঁড় করায়। ভালোবাসাহীন দ্রৌপদীর অব্যক্ত বেদনা আর বঞ্চিত একলব্যের কষ্টে মহাভারত ভেঙে রচিত হয় ভিন্ন পুরাণ।

এই ভিন্ন পুরাণটি আমরা দেখি প্রায় নিরাভরণ একটি মঞ্চে—সামান্য উচ্চতার দুটি র‍্যাম্প এবং তার ওপর দ্রোণাচার্যের আবক্ষ মূর্তি—মঞ্চ পরিকল্পক কমালউদ্দিন কবির মঞ্চ সাজিয়েছেন এভাবে। এখানে একলব্য চরিত্রের মামুন চৌধুরী ও দ্রৌপদীরূপী বন্যা মির্জা বর্ণনাত্মক ও চরিত্রাভিনয়ের মিশেলে ‘একা মালিনীর মধ্যে সমস্ত বাগান আপনি’ যেন জাগিয়ে তুললেন। তবে কোনো কোনো সময় মামুন যে সময় উচ্চলয়ে সংলাপ দিয়েছেন (দীর্ঘ সময় ধরে), কখনো কখনো ফেটে গেছে তাঁর কণ্ঠ। এটি বাদ দিলে নিত্যপুরাণ-এ মামুন খারাপ নম্বর পাবেন না।

দ্রৌপদী হিসেবে বন্যা মির্জা যখন মঞ্চে এলেন, তুলে ধরলেন নিজের বঞ্চনার বিবরণ। মনে হলো ‘কলাবিদ্যার একেশ্বরী’রূপে ফুটে উঠেছেন তিনি। কিন্তু ঝামেলা ঘটেছে অন্যত্র—একলব্য ও দ্রৌপদী এককভাবে নিজ নিজ চরিত্রে যথেষ্ট পারাঙ্গমতা দেখিয়েছেন বটে, তবে একলব্য ও দ্রৌপদীর কথপোকথনকালে বেশিরভাগ সময় একলব্য ছিলেন উচ্চগ্রামে বাঁধা। ফলে এই দুজনের মধ্যকার অভিনয়শৈলীর ফারাক এবং বিষদৃশ্য চোখে বিঁধেছে কাটার মতো।

বিষদৃশ্য আরও আছে—মঞ্চটি নিরাভরণ এবং ‘সাজেশটিভ’। প্রযোজনার ধরনেও রয়েছে নিরাভরণতার ছাপ। কিন্তু পোশাকের ক্ষেত্রে ঘটল ব্যতয়। পোশাক পরিকল্পক শাহনেওয়াজ কাকলী বেশ জাকালো রঙের পোশাক পরিয়েছেন অভিনয়শিল্পীদের—অনেকটা বাস্তববাদী পরিচ্ছদ। মঞ্চ ও গোটা নাট্য পরিকল্পনার সঙ্গে পোশাকের সমন্বয়হীনতা নাটকের ইউনিটি ও হারমনির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্দেশক ও পোশাক পরিকল্পকের মাথায় কী চিন্তা কাজ করেছে কে জানে। ছোট্ট একটা উদহারণ দিই: দ্রৌপদীকে পরানো হয়েছে গাঢ় নীল পাজামার ওপর একই রঙের খানিকটা নাচের পোশাকের কাছাকাছি ধরনের একটি পোশাক। পোশাকটি দ্রৌপদী চরিত্রকে উজ্জ্বল তো করেইনি, মানানসইও মনে হয়নি।

আলো ব্যবহারে আলাদা কোনো ক্যারিশমা নজরে পড়ল না। আবহ সংগীতে ছিল ধ্রুপদি ঘরানার প্রাধান্য। তবে এই প্রযোজনার সবকিছু যেহেতু ছিল থিয়েট্রিক্যাল, ফলে ধারণ করা সংগীত ব্যবহার না করে সংগীত আয়োাজনটি থিয়েট্রিক্যাল হলে আরও ভালো হতো।

একলব্য–দ্রৌপদীর বাইরে অনান্য অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ও ছিল বলার মতো। কিন্তু এখানে বেশ কয়েকজন অভিনেতাকে ব্যবহার করা হয়েছে একলব্য ও অর্জুনের আয়না হিসেবে। ব্যাপারটির মধ্য অভিনবত্ব আছে। তবে আয়নাদের অভিনয় আরও সাবলীল হলে ভালো লাগত।

‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শ্রাব্যকাব্যের চেয়ে দৃশ্যকাব্য স্বভাবতই কতকটা পরাধীন বটে। বাহিরের সাহায্যেই নিজেকে সার্থক করিবার জন্য সে বিশেষভাবে সৃষ্ট। সে যে অভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে, এ কথা তাহাকে স্বীকার করিতেই হয়।’ হ্যাঁ, অভিনেতাদের অভিনয়গুণেই নানান বিষদৃশ্য, হারমনি ও ইউনিটির ঘটতি সত্ত্বেও এই নিত্যপুরাণ আমাদের ভালো লেগেছে। কিন্তু অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া বলে যে কথাটি আছে, এই ভালো লাগা তেমন নয়। আমরা শুধু এক বাক্যে বলতে পারছি, ‘ভালো’।