শশী অস্ত গেল

>

পরিবারের সঙ্গে শশী কাপুর
পরিবারের সঙ্গে শশী কাপুর

চিরদিনের মতো বলিউডের আকাশ থেকে মুছে গেল শশী নামের উজ্জ্বল তারাটি। ৪ ডিসেম্বর ৭৯ বছর বয়সে চলে গেলেন হাসি-খুশি, নরম স্বভাবের সবার প্রিয় অভিনেতা শশী কাপুর। এ যেন একটা প্রজন্মের বিদায়। শুধু চলচ্চিত্র নয়, নাট্যজগৎও তাঁকে ছাড়া আজ যেন পিতৃহীন। ভারতের চলচ্চিত্র ও নাটকের জগতের কিছু চেনাজনের স্মৃতিতে উঠে এলেন দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারজয়ী এই সুদর্শন ও গুণী অভিনেতা।

শশী কাপুর
শশী কাপুর

মৌসুমি চ্যাটার্জি, অভিনেত্রী
আজ শশী কাপুরকে ঘিরে অনেক কথাই মনে পড়ছে। তাঁর কাছ থেকে যেমন অনেক কিছু শিখেছি, তেমনি বকাও খেয়েছি অনেক। আমি শশী কাপুরকে ‘আঙ্কেল’ বলে ডাকতাম। মহাবালেশ্বরে আনারি ছবির জন্য তাঁর সঙ্গে একটা রোমান্টিক গানের দৃশ্যে শুটিং করছি। শুটিং চলার সময় তিনি আমায় ডেকে বললেন, তাঁকে যেন ‘আঙ্কেল’ না ডাকি। কারণ আশপাশে ভক্তরা তাঁর শুটিং দেখতে এসেছেন। তার ওপর আমরা একটা রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করছি। বাংলাতে আমরা অনেককেই ‘তুমি’ বলে থাকি। শশী কাপুরকেও আমি ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘আমাকে “তুমি” বোলো না। আমাকে “আপনি” করে বলবে। সম্মান আর শ্রদ্ধা তোমাকে নিজের চেষ্টায় অর্জন করতে হবে। তুমি এমনি এমনি পেয়ে যাবে না।’ আজ আমি বুঝি তিনি কেন আমায় শাসন করতেন।

স্ত্রী জেনিফার কেন্দালের সঙ্গে শশী কাপুর
স্ত্রী জেনিফার কেন্দালের সঙ্গে শশী কাপুর

সুভাষ ঘাই, নির্মাতা
আজ সত্যি আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত। আমার কাছে শশীজি একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু সিনেমা নয়, নাটকের প্রতিও তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা। এই ভালোবাসা ও আবেগ দিয়ে ভারতীয় সিনেমা আর নাটকের প্রভূত উন্নতি করেছেন তিনি। আমি তাঁর সঙ্গে দুটো ছবিতে কাজ করেছি। ৭০-এর দশকে গৌতম গোবিন্দা আর ক্রোধী। আমি তাঁর থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সবচেয়ে বেশি শিখেছি নিয়মানুবর্তিতা আর সময়ের পরিকল্পনা। কীভাবে মাটির সঙ্গে মিশে থাকা যায়, সেটাও আমাকে শিখিয়েছেন শশী কাপুর।

শশী কাপুর ও হেমা মালিনী
শশী কাপুর ও হেমা মালিনী

পুনম ধীলন, অভিনেত্রী
কয়েক দিন ধরে শুধু শশীজির বিষয়েই কথা বলে আসছি। আমি আমার অভিনয়ের জীবনের শুরু থেকেই তাঁকে দেখে আসছি। ভীষণই হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, নরম মনের মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন খুব কষ্ট হতো তাঁকে দেখে। কয়েক বছর ধরে হুইলচেয়ারেই আটকে গিয়েছিলেন। এভাবে তাঁকে দেখতে খুব কষ্ট হতো আমার। আমি যে শশী কাপুরকে দেখে এসেছি, তাঁর সঙ্গে আজকের এই মানুষটার কোনো মিল পেতাম না। অত বড় পরিবারের সন্তান, এত বড় মাপের অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও একদমই মাটির মানুষ ছিলেন তিনি। একদম সাদামাটা। কোনো রকমের দাবি ছিল না তাঁর। সহ-অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান থেকে স্পটবয়—সবার সঙ্গে শশী কাপুর একই রকম ব্যবহার করতেন। তাই সবার প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। প্রিয়ই হয়ে থাকবেন।

শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে শশী কাপুর
শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে শশী কাপুর

শেখর সুমন, অভিনেতা
শশী কাপুর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন। এই মানুষটিকে আদর্শ করেই আমি আমার অভিনয়জীবন গড়েছি। আজ আমি পেশাগতভাবে যা কিছুই অর্জন করেছি, তা তাঁর জন্যই সম্ভব হয়েছে। আমি তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। উনি আমাকে উৎসব সিনেমাতে রেখার বিপরীতে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছিলেন। সেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে প্রথম ও বড় সুযোগ। আমি আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে তাঁর অভাব বোধ করব। শশী কাপুরের মতো সুদর্শন পুরুষ আমি বলিউডে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। আপাদমস্তক ভদ্র একজন মহান অভিনেতা এবং একজন আবেগপ্রবণ প্রযোজক।

নাদিরা জহীর বাব্বর, অভিনেত্রী
শশী কাপুরের প্রয়াণে মনে হচ্ছে আজ আবার আমি পিতৃহীন হলাম। মঞ্চনাটকের প্রতি তাঁর অসম্ভব আবেগ আর ভালোবাসা ছিল। পৃথ্বী থিয়েটারকে তিনি বোধহয় নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। ভারতের নাট্যজগৎ আজ শশী কাপুরের জন্যই একটা সম্মানজনক উচ্চতায় পৌঁছেছে। তিনি চার বছর আগে পর্যন্তও আমার সব নাটক দেখতে থিয়েটারে আসতেন। পরে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর নাটক দেখতে আসতে পারতেন না। নাটক মঞ্চস্থের পরের দিন সকালে শশী কাপুর আমার জন্য নিজের হাতে চিঠি লিখে পাঠাতেন। চিঠিতে আমার অভিনয়ের প্রশংসা লিখতেন তিনি। চিঠির সঙ্গে থাকত কেক আর একগুচ্ছ ফুল।
গ্রন্থনা: দেবারতী ভট্টাচার্য, মুম্বাই থেকে