'ফাগুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার, মা বলেছেন জন্ম আমার'

>
শাহ আবদুল করিম
শাহ আবদুল করিম

‘বন্দে মায়া লাগাইছে,’ ‘গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী’সহ অসাধারণ সব গানের জনক শাহ আবদুল করিম। ‘বাউলসম্রাট’খ্যাত এই শিল্পীর গোটা জীবন কেটেছে গানের সঙ্গে। লোকায়ত ধারার এই বাউল-কবির গানে ফুটে ওঠে ভাটি অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ আর প্রকৃতির রূপ। আজ এই বাউল কবির জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করেছেন মাসুম আলী

সেই বিকেলের কথা খুব মনে পড়ে। বসন্তের বিকেল। ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। জন্মদিনকে উপলক্ষ করে ছোট্ট ঘরোয়া আয়োজন ছিল। সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামের বাড়িতে বসে শাহ আবদুল করিমের মুখেই শুনি তাঁর জন্মদিনের গল্পটা।

নিজের জন্মতারিখটা মনে রেখেছিলেন গান বেঁধে, ‘ফাগুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার, মা বলেছেন জন্ম আমার’। অনেক গল্প সেদিন শুনেছিলাম। গানের গল্প, বেড়ে ওঠার গল্প, থেমে না যাওয়ার গল্প। স্থপতি ও নির্মাতা শাকুর মজিদ তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ভাটির পুরুষ-এ এসব ধারণ করেন। সেবার মূলত তাঁর অসিলায় দিরাই যাওয়া।

‘মায়া লাগাইছে’ গানের স্রষ্টার মধ্যেই গভীর এক মায়া ছিল। মায়া ছিল নির্লোভ-নিরহংকার মানুষটার কথায়, হাসিতে, চলাফেরায়।

শাহ আবদুল করিমকে দেখার, কথা বলার তীব্র ইচ্ছায় বেশ কয়েকবার ছুটে গেছি তাঁর গ্রামে! শুনেছি তাঁরই ভাবশিষ্য আবদুর রহমান, রোহী ঠাকুর, কাইয়ুম শাহ, রণেশ ঠাকুরদের মায়াবী কণ্ঠের প্রচলিত-অপ্রচলিত কত গান। পেয়েছি তাঁর ছেলে শাহ নূর জালালের আন্তরিক আতিথ্য।

শহর, আড়ম্বর, আভিজাত্য—এসব আবদুল করিমের ভালো লাগত না। যে কয়বার তাঁকে ঢাকায় দেখেছি, তিনি ছটফট করেছেন কখন বাড়ি যাবেন। কালনী নদীর পাড়ে যাবেন। ছেলেকে বারবার তাগাদা দিতেন, ‘কিতা বাড়ি যাইত না’!

শেষ বয়সে সিলেটে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আবদুল করিম এসেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে আয়োজকেরা সোয়া তিন লাখ টাকার চেক তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন, সেটা ছিল সোয়া তিন হাজার টাকার চেক! চেক হাতে নিয়ে আয়োজকদের উদ্দেশে মন্তব্য করলেন, ‘আপনাদের ভালো লাগায় আমি মুগ্ধ। আমার মতো নিতান্তই অভাজন এক ব্যক্তির হাতে আপনারা সোয়া তিন হাজার টাকা তুলে দিলেন। আপনাদের ভালোবাসার এই অশেষ ঋণ আমি আজীবন মনে রাখব।’ তাত্ক্ষণিকভাবে উপস্থিত আয়োজকদের একজন করিমের ভুল ভাঙিয়ে জানান যে সোয়া তিন হাজার নয়, সোয়া তিন লাখ টাকার চেক সম্মাননাস্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয়েছে।

কথা শুনে বাউলসম্রাট চমকে উঠলেন। চেয়ারে বসা ছিলেন, মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘অসম্ভব! এটা আমি নেব না। আমার এত টাকার প্রয়োজন নেই। আমি চাই শুধু আপনাদের ভালোবাসা।’ বাউলসম্রাটের নির্লোভ চরিত্রের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে সেদিন মিলনায়তনভর্তি মানুষের চোখ ভিজে উঠেছিল। কথাটা শুনেছি সেদিন সেখানে উপস্থিত থাকা সাংবাদিক ও লোকগানের গবেষক সুমনকুমার দাশের কাছ থেকে।

দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনুরাগীরা তাঁর বাড়িতে তাঁর সন্তানের মতোই বসবাস করতেন। বাড়ির পাশের দুই ভাই রণেশ ও রোহী ঠাকুর ছিলেন তাঁর খুব কাছের মানুষ। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না তাঁর অন্তরে। মানুষকে জানা ও মানুষকে ভালোবাসার প্রচারণা করে গেছেন সারা জীবন।

এই যে তাঁর গান গেয়ে এত মানুষ জনপ্রিয় হলো, আয় করল—এসব নিয়ে কখনো তিনি প্রতিবাদ দূরের কথা, অভিযোগও করেননি। শুধু বলতেন, আমার গানের বাণী যেন ঠিক থাকে, সুর যেন ঠিক থাকে।

সারা জীবনই সংগ্রাম করে গেছেন মানুষটা। শৈশব-কৈশোরে খেয়ে না-খেয়ে চলেছে জীবন। দুই টাকা মাসিক বেতনের রাখালের চাকরি ছেড়ে গ্রামের পার্শ্ববর্তী ধলবাজারের এক মুদির দোকানে কাজ করেছেন। দিনে চাকরি আর রাতে হাওর-বাঁওড়ের ধারে ঘুরে ঘুরে গান গাওয়া। ওই সময় গ্রামে খোলা হয় নৈশ বিদ্যালয়। ভর্তি হলেন তাতে। কিছুদিন পর গ্রামে গুঞ্জন উঠল—এই বিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করবে, তাদের বিশ্বযুদ্ধে (প্রথম) নিয়ে যাওয়া হবে। বালক করিম আর বিদ্যালয়মুখী হননি।

দিন যায়। করিম গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতে শুরু করেন। নিজের এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে আশপাশের উপজেলায় নাম ছড়াতে থাকে তাঁর। করিম বাউলের খোঁজে মানুষ আসে অন্য অঞ্চল থেকেও। এরপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, কাগমারী সম্মেলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যেন বেড়ে ওঠেন শাহ আবদুল করিম ও তাঁর গান। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছেন এই গানের জন্য। এসব তুখোড় রাজনীতিবিদের বক্তৃতার পাশাপাশি শাহ আবদুল করিম গণসংগীত গেয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে উজ্জীবিত করতেন মানুষকে। ১৯৬৮ সালে সতীর্থ বাউল দুরবীন শাহকে নিয়ে বিলেতে যান গান গাইতে। আবদুল করিম সিলেট বেতারে নিয়মিত আঞ্চলিক গান গাইতে শুরু করেন ১৯৭৪ সাল থেকে।

নিজের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ও বাউলদর্শন বিলিয়ে দিতে ক্লান্তিহীন হেঁটেছেন গানের প্রান্তরে। সাত দশকব্যাপী নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে সংগীতসাধনা করতে করতে নিজের অজান্তেই অমরত্বের পথটি তৈরি করে নিয়েছেন।

প্রথম আলোকেদেওয়া সাক্ষাৎকারে শাহ আবদুল করিম ‘গাড়ি চলে না’ গানটি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘বন্ধুর বাড়ি এ আত্মায়। গাড়িতে চড়ে আত্মশুদ্ধির সন্ধানে ছুটি। কিন্তু পাই না। রিপু থামিয়ে দেয়। একদিন হয়তো এই গাড়ি পুরোদমে থেমে যাবে। প্রকৃত মালিকের কাছে ধরা দেবে। এই করিমকে তখন মানুষ খুঁজে পাবে শুধুই গানে আর সুরে।’

ভাবতেও কষ্ট লাগে। ধলআশ্রম গ্রামের সেই মানুষটা আর কখনো ভরা বর্ষায় উত্তাল হাওরের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবেন না। একতারা হাতে কালনীর কূলে বসে গাইবেন না ‘কোন মেস্তুরি নাও বানাইল, কেমন দেখা যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নাও’।