প্রযোজক বনে যাওয়া নায়িকারা

শাবানা, ববিতা, কবরী, মৌসুমী, মাহি ও পরীমনি
শাবানা, ববিতা, কবরী, মৌসুমী, মাহি ও পরীমনি

কেউ বা শখের বশে, কেউ নিজেদের থমকে যাওয়া অভিনয়জীবনে নতুন গতির সঞ্চার করতে, আবার কেউ ভালো চলচ্চিত্র পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করতে প্রযোজনায় নাম লিখিয়েছেন। দেশীয় চলচ্চিত্রের নায়িকারা যুগে যুগে এমন ভাবনা থেকে নায়িকা অবস্থায় ছবি বানানোর সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেন। দেশ স্বাধীনের আগে থেকে এই প্রচলন শুরু হয় বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়েখ্যাত কবরী। শুক্রবার এই ক্লাবে যোগ দেন হালের আলোচিত-সমালোচিত নায়িকা পরীমনি। প্রথম আলো পাঠকেরা এক নজরে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন, কোন কোন নায়িকা ছবি প্রযোজনায় নাম লিখিয়েছেন।

সুজাতা
১৯৬৫ সালে ‘রূপবান’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর সুজাতার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ‘রূপবান কন্যা’কে এক নজর দেখার জন্য ভক্তরা ছিলেন অস্থির। ‘রূপবান’ ছবিটি মুক্তির পর থেকেই আশির দশকের আগে পর্যন্ত ছিলেন শীর্ষ নায়িকাদের একজন। জীবনের পথে আজিম-সুজাতা চলতে শুরু করেছিলেন ১৯৬৫ সালে ‘ডাকবাবু’ ছবিতে অভিনয়ের সময়। আমৃত্যু সে সম্পর্ক ছিল পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ। চলচ্চিত্রের কারণে সবাই তাঁকে সুজাতা হিসেবে চিনলেও তাঁর নাম আসলে তন্দ্রা মজুমদার। গুণী নির্মাতা আমজাদ হোসেন ‘রূপবান’ ছবির পরিচালক সালাহউদ্দিনের সঙ্গে ‘তন্দ্রা’কে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনিই তন্দ্রা নাম পরিবর্তন করে ১৯৬৩ সালে তাঁর পরিচালিত ‘ধারাপাত’ ছবিতে সহনায়িকা হিসেবে নাম রাখেন ‘সুজাতা’। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০টি ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন সুজাতা। সব মিলিয়ে তিন শ ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। সুজাতা পরিচালিত একমাত্র চলচ্চিত্র ‘অর্পণ’। এই ছবির প্রযোজকও ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৬ সালে প্রথম প্রযোজনায় আসেন তিনি। নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত সুজাতা প্রোডাকশনের ব্যানারে নির্মিত হয় তাঁর ‘প্রতিনিধি’ ছবি। এই ছবিতে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। ছবিটির পরিচালক ছিলেন অভিনেতা ও স্বামী আজিম। ‘সুজাতা প্রোডাকশনস’ ছাড়াও সুজাতা-আজিম মিলে ‘এস এ ফিল্মস’ ও ‘সুফল কথাচিত্র’ নামের আরও দুটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। তিনটি প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে নির্মিত হয়েছে ‘চেনা–অচেনা’, ‘টাকার খেলা’, ‘প্রতিনিধি’, ‘অর্পণ’, ‘রূপবানের রূপকথা’, ‘বদলা’, ‘রং–বেরং’, ‘এখানে আকাশ নীল’ ইত্যাদি।

কবরী
কবরী


কবরী
ষাটের দশকে নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ছবিপ্রেমী দর্শকদের কাছে নায়িকা কবরীর সাক্ষাৎ মেলে। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই একটি ছবি তাঁকে আলোচনায় নিয়ে আসে। প্রথম ছবি মুক্তির পাঁচ বছরের মাথায় প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কবরী। শুরুতে শ্রীমতী প্রোডাকশন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরে প্রথম ছবি ‘শীত-বসন্ত’ সেন্সরে জমা দেওয়ার পর আপত্তির মুখে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ফেলতে বাধ্য হন। শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘শীত-বসন্ত’ ছবিতে কবরীর বিপরীতে অভিনয় করেন আজিম। সুভাষ দত্তের পরিচালনায় পরের ছবি ‘বলাকা মন’ যখন মুক্তি পায়, তখন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম হয়ে যায় কবরী প্রোডাকশন। কবরীর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তি পাওয়া শেষ ছবিটি ছিল ‘গুন্ডা’। আলমগীর কুমকুম পরিচালিত এই ছবিতে কবরীর সহশিল্পী ছিলেন রাজ্জাক।

ববিতা
ববিতা


ববিতা
চলচ্চিত্রে আসার পেছনে বড় বোন সুচন্দার অনুপ্রেরণা ছিল। বড় বোন সুচন্দা অভিনীত ‘সংসার’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে ববিতা অভিনয় করেন ১৯৬৮ সালে। এই ছবিতে তিনি রাজ্জাক-সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবির জগতে প্রথম যখন অভিনয় করেন, তখন নাম ছিল সুবর্ণা। একটি টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় করেন তিনি। জহির রায়হানের ‘জ্বলতে সুরুজ কি নিচে’ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে ববিতা নাম ধারণ করেন। ১৯৬৯ সালে ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ পান তিনি। ছবিটি যেদিন মুক্তি পায়, সেদিন তাঁর মা মারা যান। শুধু অভিনয়দক্ষতা দিয়ে সত্তরের দশকে নিজের জাত চেনাতে সক্ষম হন। ‘টাকা আনা পাই’ ছবিটি তাঁর অভিনয়জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর তো নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’ ছবিতে অভিনয় করেন, যা ছিল সুপারহিট ব্যবসা করে। দেশের চলচ্চিত্রের এই নায়িকাও ছবি প্রযোজনায় নাম লেখান। ববিতা মুভিজের ব্যানারে তৈরি প্রথম ছবি ‘ফুলশয্যা’। এই ছবির পরিচালক ছিলেন সুভাষ দত্ত। এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে নির্মিত ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ ছবির পরিচালক আখতারুজ্জামান। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি প্রযোজনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেন। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ কয়েকটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।

শাবানা
শাবানা


শাবানা
মাত্র আট বছর বয়সে চলচ্চিত্র নাম লেখান শাবানা। এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ নামের ছবিতে তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৭ সালে ‘চকোরী’ ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় শুরু। ২২ বছর ধরে টানা অভিনয় করার পর চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নাম লেখান শাবানা। স্বামী ওয়াহিদ সাদিককে সঙ্গী করে গড়ে তোলেন এসএস প্রোডাকশন হাউস। নিজের প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘মাটির ঘর’ তাঁকে প্রযোজক হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়। এরপর ২৫টির বেশি ছবি প্রযোজনা করেছেন শাবানা। ১৮ বছর ধরে অভিনয় থেকে দূরে সরে আছেন চলচ্চিত্রের গুণী এই অভিনয়শিল্পী। অভিনয়জীবনে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় হুট করেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান তিনি। অভিনয় থেকে দূরে থাকলেও শেষবার যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখন প্রথম আলোকে শাবানা জানিয়েছিলেন, ছবি প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন।

মৌসুমী
মৌসুমী


মৌসুমী
নব্বইয়ের দশকের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দেশের চলচ্চিত্রে আলোড়ন তোলেন মৌসুমী। ছবিতে অভিনয়ের আগে ছোট পর্দায় কাজ করলেও বড় পর্দায় প্রথম কাজটি দিয়ে বাজিমাত করেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে অভিনয়ে আসার কয়েক বছরের মাথায় অভিনেত্রী মৌসুমীও প্রযোজক হিসেবে নাম লেখান। ১৯৯৬ সালে নির্মিত হয় তাঁর প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘গরিবের রানি’। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কপোতাক্ষ চলচ্চিত্র থেকে দুই বছর আগে তিনটি ছবি প্রযোজনার ঘোষণা দিয়েছিলেন মৌসুমী। তখন মৌসুমী বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্রের এই দুঃসময়ে আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। চলচ্চিত্রই আমাকে মৌসুমী বানিয়েছে। এবার এই ইন্ডাস্ট্রিকে কিছু দিতে চাই।’

মাহী
মাহী


মাহী
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আড়াই বছরের মাথায় প্রযোজনার ঘোষণা দেন হালের আলোচিত নায়িকা মাহিয়া মাহী। তরুণ এই নায়িকা জানিয়েছিলেন, তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের প্রথম ছবির পরিচালক হবেন জাকির হোসেন। মাস পেরিয়ে বছর চলে গেলেও ‘স্করপিয়ন’ নামের সেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে আজও কোনো ছবি নির্মিত হয়নি। প্রযোজনার বিষয়ে মাহি বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্রের সময়টা বদলে যাচ্ছে। সামনে ভালো দিন আসছে। আমি এ সময়ের একজন সাক্ষী হয়ে থাকতে চাই। কাজটি নিয়মিতই করতে চাই।’
অনেকেই বিষয়টিকে মাহির ‘ফাঁকা আওয়াজ’ বলে মনে করছেন। কেউ কেউ আবার বলছেন, মাহির অভিষেক হওয়া প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে যদি বিরোধে না জড়াতেন, তাহলে হয়তো ঠিক সময়ে শুটিংয়ে গড়াত মাহির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ছবির।

পরীমনি
পরীমনি


পরীমনি
‘ভালোবাসা সীমাহীন’ ছবি দিয়ে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে পরীমনির। তার আগে টেলিভিশন নাটকে টুকটাক অভিনয় করতেন তিনি। গত শুক্রবার বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে এফডিসির ৭ নম্বর ফ্লোরে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা দেন এই সময়ের আলোচিত ও সমালোচিত নায়িকা পরীমনি। অভিনয়ের তিন বছরে মাথায় বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে ‘সোনার তরী’ নামের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা দেন পরীমনি। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই নায়িকা প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘ক্ষত’র শুটিং শুরু হবে বলে জানান। শামীম আহমেদ পরিচালিত ছবিতে নায়ক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন জায়েদ খান।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বিভিন্ন সময় অভিনয়ের পাশাপাশি আরও অনেক নায়িকা প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এঁদের মধ্যে সুমিতা দেবী, মালতি দে, সুচন্দা, মাহবুবা রহমান, সুলতানা জামান, নীলুফার খায়ের, জোহরা কাজী, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, এ প্রজন্মের ববি উল্লেখযোগ্য। একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পপি দীর্ঘদিন ধরেই ছবিতে নিয়মিত নন। সম্প্রতি তিনি আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। তাঁরও ইচ্ছে আছে ছবি প্রযোজনার। তাঁর মতে, ‘এই চলচ্চিত্রশিল্প আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছে। সে কারণেই অন্য কোথাও টাকা লগ্নি না করে চলচ্চিত্রেই বিনিয়োগ করব।’