নাচ করে ভাইরাল হওয়া যায় নাকি?

অর্থী আহমেদ। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
অর্থী আহমেদ। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

যানজট সাঁতরে হন্তদন্ত হয়ে পৌঁছলেন তিনি। পরনে শার্ট-প্যান্ট। এই পোশাকে বাইক চালাতে সুবিধা হয়। আগের দিন, উনিশ ফাল্গুন সন্ধ্যায় পরেছিলেন নানুর সাদা জামদানি। সেদিনের দায়িত্ব ছিল কল্পতরুর শিশুদের ভরতনাট্যমের পোশাকে সাজানো। আর তার আগের দিন সন্ধ্যাটা ছিল নিজের। সেদিন তিনি পরেছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় কাঞ্জিভরম শাড়ি। তিন মিনিটের ব্যবধানে শাড়ি বদলাতে হয়েছিল দুবার, ভরতনাট্যমের কস্টিউম। সেই সন্ধ্যার কথা লিখে রাখা দরকার। পুষ্পাঞ্জলি, ভারনাম, দেভারনামা ও তিল্লানার এক অপূর্ব সন্ধ্যা।

উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে কলকাতায় পড়তে গিয়েছিলেন মায়ের ‘লাতুপুতু’ মেয়ে অর্থী। বৃত্তি পেয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভরতনাট্যমে স্নাতক-স্নাতকোত্তর। শেষ করে ফেরার পর প্রথম মঞ্চ পরিবেশনা সেই সন্ধ্যায়, ঢাকায় দুদিনের ভরতনাট্যম উৎসব। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি মিলনায়তনের লোকগুলোকে পলক ফেলতে দেননি অর্থী। এমনকি নিজের মাকেও না। মা হয়তো ভেবেছেন, এই তো সেদিন মেয়েটা কলকাতায় পড়তে গেল। বাজারে গিয়ে ভিডিও কল দিয়ে জিজ্ঞেস করত, ডাল কিনব কোনটা—লালটা, না হলুদটা? রান্নার সময়ও ভরসা স্কাইপি। মায়ের কাছে জানতে চাইত, কোনটার পর কোন মসলা দিতে হবে। একসময় নুডলস রান্না করতে যে মেয়ে হালুয়া বানিয়ে ফেলত, সে এখন পাকা রাঁধুনি।

এসব গল্প শুনতে একদিন প্রথম আলোয় আমন্ত্রণ জানানো হয় অর্থী আহমেদকে। তারপর গল্প আর ফুরোতেই চায় না। নিজের গল্প বলছিলেন না, যেন উল্টে চলছিলেন নিষ্ঠাবান এক নৃত্যশিল্পীর দিনলিপির পৃষ্ঠা। তারপর? ‘তারপর ময়লাওয়ালার বাঁশি শুনে ভোর ছয়টায় ঘুম ভাঙত। বিদেশি ছাত্রীদের ক্যাম্পাসের বাইরে বাসা ভাড়া করে থাকতে হতো। একা রাঁধতে হতো, খেতে হতো। কপাল ভালো, ভালো কিছু বন্ধু জুটেছিল, নিঃসঙ্গ লাগত না। তিন দিন কোনো দোকানে গেলে, চতুর্থ দিন দোকানিও বন্ধু হয়ে যেত।’ বাড়ি ফেরার পর ঢাকার বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া কী? কী বলছে তারা? বন্ধুদের ভঙ্গি নকল করে অর্থী বললেন, ‘তুই তো পুরা কলকাতার দিদিদের মতো বাংলা শিখেছিস রে!’

নৃত্যশিল্পী অর্থীর হাতেখড়ি ঢাকার শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বেলায়েত হোসেন খানের কাছে। সেই ছোট্টবেলায়, ছায়ানটে। অনার্সে গুরু ছিলেন মিলন অধিকারী আর মাস্টার্সে শ্রীমতী সুজাতা রামালিঙ্গম। মায়ের মতো করে দেখভাল করতেন সুজাতা। অর্থীকে তিনি গড়ে দিয়েছেন কলা ও সাহসের নন্দিনী রূপে। মঞ্চ এখন যত বড়ই হোক না কেন, বুক কাঁপে না তাঁর। গত বছর কলকাতার আইসিসিআর মিলনায়তনে তৈরি করা হয়েছিল সে রকমই এক রোমাঞ্চকর মঞ্চ। বিদেশি শিল্পীদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক ভরতনাট্যম নৃত্য করে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। শুধু কি তাই? ভারতের হায়দরাবাদ, বেনারস, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, পশ্চিম ভার্জিনিয়াসহ আরও বেশ কিছু মঞ্চে ভরতনাট্যম পরিবেশনা তাঁকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। সিদ্ধান্ত এখন পাক্কা, নৃত্য আর কোরিওগ্রাফিই হবে তাঁর প্রধান পেশা। তবে এ–ও মানেন, নাচ শেখানো তাঁর গুরুদায়িত্ব।

কথায় কথায় আসে সাধনার কথা। শ্রদ্ধায় নত হয়ে নাম নেন লুবনা মারিয়ামের। অর্থীর উদ্যম ও সম্ভাবনা দেখে সাধনার প্রায় সব প্রযোজনাতেই তাঁকে রেখেছিলেন এই নৃত্যশিল্পী ও সংগঠক। সব সময় খোঁজ নিয়েছেন পড়ালেখার। তিনি পাশে ছিলেন বলেই অর্থীর পথ ছিল মসৃণ আর মঞ্চ ছিল ভয়হীন।

কদিন আগে ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী প্রিয়ার কথা বললাম তাঁকে, ‘ধরুন, এক সকালে হঠাৎ ভাইরাল হয়ে গেলেন?’ অর্থীর নির্বিকার জবাব, ‘শুধু শাস্ত্রীয় নাচ করে ভাইরাল হওয়া যায় নাকি? যদি পাশাপাশি সিনেমায় কাজ করতাম, তাহলে না হয় কিছু একটা হতো। যা হোক, সিনেমায় একদিন কাজ করব। তবে সেটা ক্যামেরার সামনে নয়। সিনেমা বানাব।’