কান উৎসবে বাংলাদেশের শূন্যতা

কান উৎসবের লাল গালিচায় তিন উপস্থাপক। ছবি: সংগৃহীত
কান উৎসবের লাল গালিচায় তিন উপস্থাপক। ছবি: সংগৃহীত

শুধু কি প্রতিযোগিতা বিভাগের ২১টি ছবির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসব? দূরদেশ থেকে উৎসবটি দেখলে এমনটা মনে হতেও পারে। উৎসবের পরিধি কিন্তু এর চেয়েও অনেক বিস্তৃত। উৎসবের আঁ সারতেঁ রিগার, ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট কিংবা ক্রিটিকস উইক—এখানেও নানা চমক আর বিস্ময়ের ছড়াছড়ি। এসব বিভাগে আসা ছবিগুলো দেখার জন্যও মানুষের সে কী নিরন্তর অপেক্ষা! বিশ্বকাপে মেসির একটি গোল দেখার জন্য যেমন তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে দর্শক, তেমনই তৃষ্ণার্ত থাকে নুরি বিলগে চেলান কিংবা আসগর ফরহাদির একটি ছবির জন্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, প্ল্যাকার্ড হাতে সিনেমা দেখার জন্য মানুষ বসে থাকে রাস্তায়—এমন দৃশ্য কান ছাড়া খুব একটা দেখা যায় না।

লালগালিচায় কে হাঁটছেন—এটা দেখার জন্যও আলাদা গ্যালারি বানানো আছে। সেখানে দর্শক বন্ধু-পরিবার নিয়ে চিপস, কেক, পানীয় খেতে খেতে দেখেন তারকাদের আনাগোনা। ওদিকে লালগালিচায় চলছে অনবরত ধারাভাষ্য। ধারাভাষ্যকার সরাসরি সম্প্রচারে বলছেন,‘স্বচ্ছ আকাশে রোদ ঝলমল করছে। সেটা লালগালিচায় এসে পড়েছে। সেই রোদের মধ্য দিয়েই হেঁটে আসছেন লিয়া সেদু। হলুদ গাউন পরা লিয়ার ডান পাশে হলিউড অভিনেত্রী ক্রিস্টেন স্টুয়ার্টও আছেন। তাঁরা দুজনই এবারের প্রতিযোগিতা বিভাগের জুরি। কানে কানে কিছু বলছেন তাঁরা। আলোকচিত্রীদের ছবি তোলা শেষ। এখন সিঁড়ি বেয়ে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন উৎসবপ্রধান থিয়েরি ফ্রেমোর দিকে। থিয়েরি একটু বাঁয়ে পাশ কাটিয়ে দিয়ে প্রথমে হাত বাড়ালেন লিয়ার দিকে। স্বাগত জানালেন। এরপর ক্রিস্টেনকেও স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পালার ভেতরে।…’
এভাবেই ধারাভাষ্য চলছে তো চলছেই। ঠিক যেমনটা কোনো ক্রিকেট কিংবা ফুটবল ম্যাচের সময় চলে।

উৎসবের বাইরে কানে ছবি বাজার বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। উৎসবের মূল বিভাগে অংশ নিতে কিংবা মূল উৎসবের ছবি দেখতে যত না মানুষ আসে, তার চেয়ে বেশি মানুষ আসে এই ছবি বাজারের (মার্শে দ্যু ফিল্ম) অংশ হিসেবে। এ আয়োজনে কেউ ছবি বিক্রি করতে আসে, কেউ ছবির লোকেশন, কেউ আবার উন্নত প্রযুক্তিতে ছবি নির্মাণের কারিগরি সহযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে স্টল বসান।

পালে দ্য ফেস্তিভালের নিচতলায় বিশাল এই ছবি বাজার বসে। আর পালের বাইরে এর তিন দিকজুড়ে থাকে কান্ট্রি প্যাভিলিয়নগুলো। এই প্যাভিলিয়ন কোনো গড়পড়তা দোকান নয়। একেকটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে একেকটি প্যাভিলিয়ন। এবার তো এই কাতারে যুক্ত হয়েছে সৌদি আরবও! সেই স্টলে ঢুকতেই খরিদ্দার, বিনিয়োগকারী এমনকি সাধারণ দর্শনার্থীকেও তাঁরা খেজুর-খোরমা দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন। দেখাচ্ছেন তাঁদের দেশে বানানো সিনেমাগুলোর ট্রেলার, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন দেশটির তরুণ নির্মাতাদের সঙ্গে। তা ছাড়া তাঁদের স্টলে এবার সৌদি আরবকে সিনেমার শুটিংয়ের জন্য উপযুক্ত একটি দেশ হিসেবে প্রচার করতে চাইছেন তাঁরা। তাই যে-ই যাচ্ছেন স্টলে, তাঁকে ধরিয়ে দিচ্ছেন সৌদি ফিল্ম কাউন্সিলের তৈরি লোকেশন গাইড।

কানের বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ভারতের প্যাভিলিয়নে গিয়ে কিছু চেনা মুখ মনকে স্বস্তি দেয়, আবার অবাকও করে। এ বছর ভারত তাদের প্যাভিলিয়নে সিনেমার বাঙালি কিংবদন্তিদের বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। প্যাভিলিয়নের মূল স্ক্রিনের দুই পাশে সাঁটা চারটি মুখই বাঙালির—সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন ও সম্প্রতি ভারতের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া অভিনেতা ঋদ্ধি সেন। অমিতাভ বচ্চন, রজনীকান্তরা আছেন, তবে পেছনে, অন্য দেয়ালে। প্যাভিলিয়নে ঢুকে বাঙালিদেরই চোখে পড়ছে সবার আগে।

কানের প্যাভিলিয়নে উড়ছে নানা দেশের পতাকা। কেবল নেই বাংলাদেশ। ছবি: উৎসবের ওয়েবসাইট
কানের প্যাভিলিয়নে উড়ছে নানা দেশের পতাকা। কেবল নেই বাংলাদেশ। ছবি: উৎসবের ওয়েবসাইট

কানের এই ছবি বাজারে এবার বাংলাদেশের বলতে ছিল শুধু একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি—পোড়ামন ২। এ ছাড়া শর্ট ফিল্ম কর্নারে আছে চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি—জসীম আহমেদের আ পেয়ার অব স্যান্ডাল, নোমান রবিনের আ কোয়ার্টার মাইল কান্ট্রি, ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর রোয়াই এবং মনজুরুল আলমের মেঘে ঢাকা।
গত শনিবার হয় পোড়ামন ২ ছবিটির প্রদর্শনী। সেখানে কয়েকজন ভিনদেশি দর্শকও ছিলেন। ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধান আব্দুল আজিজ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘বেশ সাড়া পেয়েছি পোড়ামন ২ ছবিটি থেকে। অনেকে দেখে একে “ওয়েল মেড” সিনেমা হিসেবে সম্বোধন করেছেন। তবে এই ফিল্ম মার্কেটে আমাদের বাংলাদেশের উপস্থিতি আরও বাড়ানো দরকার। সামনের বছর আমরা একটা উদ্যোগ নেব বলে আশা করছি।’

কানে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের শূন্যতা এখানে আসা প্রত্যেক বাংলাদেশিই অনুভব করেন। তবে নির্মাতা সামিয়া জামানের ভাষায়, কোনো প্রস্তুতি ছাড়া হুট করে প্যাভিলিয়ন নেওয়াটা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ‘প্যাভিলিয়ন নেওয়ার জন্য একটি দেশের চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে আবেদন করতে হয়। এ জন্য অনেক পরিকল্পনা লাগবে, দূরদৃষ্টি থাকতে হবে। আমরা কী চাই সেটা নির্দিষ্ট করতে হবে, কান উৎসবের ফিল্ম মার্কেটের বিগত বছরগুলো থেকে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। তবেই প্যাভিলিয়ন নিয়ে নিজের দেশের চলচ্চিত্রক্ষেত্রকে তুলে ধরা সহজ ও ফলপ্রসূ হবে।’

লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিস্তিন—সব দেশের পতাকা যার যার প্যাভিলিয়নের ওপর উড়ছে সগৌরবে। নিজ নিজ প্যাভিলিয়নের ভেতর বাজছে দেশীয় গান, সিনেমা। আড্ডা দিচ্ছেন সেসব দেশের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, কলাকুশলী, সাংবাদিকেরা। বাংলাদেশের একটি প্যাভিলিয়নের শূন্যতা খুব বেশি অনুভূত হচ্ছে।