শিল্পীর কোনো পেনশন নেই

তাজিন আহমেদ
তাজিন আহমেদ
>সদ্য প্রয়াত অভিনেত্রী তাজিন আহমেদকে স্মরণ করে পাদপ্রদীপের আলো থেকে সরে যাওয়া শিল্পীদের নিয়ে লিখলেন নির্মাতা অনিমেষ আইচ

বয়স যখন খুবই কম, তখন মধুমিতা হলে দূরদেশ সিনেমাখানি দেখেছিলাম। দূরদেশ প্রসঙ্গ এল পারভীন ববির কারণে। একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই নায়িকার মৃত্যু ছিল ভয়াবহ করুণ এবং দুঃখজনক। ডিপ্রেশনের রোগী পারভীন ববি গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়ে মরে পড়ে ছিলেন। ৭২ ঘণ্টা পর দুধওয়ালা এবং সংশ্লিষ্টরা দরজা ভেঙে আবিষ্কার করেন তাঁর মৃতদেহ। একটা নক্ষত্রের পতন!

খুবই অল্প সময় আগে আমরা হারিয়েছি অভিনয়শিল্পী তাজিন আহমেদকে। সদা হাস্যোজ্জ্বল তাজিনের মনের কোনায় কী দুঃখ ছিল, তা আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না। আমরা দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব। হয়তো মনের ভেতর জমা থাকবে আক্ষেপ, একটু সচেষ্ট হলেই আমরা বাঁচাতে পারতাম সহকর্মী তাজিনকে। তবে এ কথা সত্য যে তাজিনের মতো আরও অনেক নিঃসঙ্গ নক্ষত্র ঘরের কোনে চুপ করে বসে আছেন; হয়তো বসে ভাবছেন অতীত দিনের স্মৃতি। এটাই বাস্তবতা, তাই এটা নিয়ে কড়চা করার কোনো সুযোগ নেই। কবির সুমনের গানে শুনেছি. ‘আজকে যে শিস দিয়ে গান গায়, কোন গান গাইবে যে কাল সে...
চল্লিশ পেরোলেই চালসে...।’

দুনিয়া চলছে মার্কেটিং পলিসির ওপর। আজ আপনাকে বাজার খায়, তাই আপনার অনেক দাম, যেদিন আর বাজার আপনাকে চাইবে না, সেদিন আপনি চলে যাবেন আস্তাকুঁড়ে। আপনি স্টার, তাই আপনার কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই, নেই কোনো স্বাধীন স্বতন্ত্র জীবন। আপনার মা হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, আপনি করিডরে পায়চারি করছেন, জনৈক ফ্যান এসে আঁকড়ে ধরে বলে, ‘ভাই আসেন সেলফি তুলি।’ আপনার মনোকষ্ট বোঝার জন্য তৈরি নয় ফ্যান ফলোয়াররা। কেন বুঝবে তারা? আপনি যে স্টার। আপনাকে বউয়ের সঙ্গে প্রাণ খুলে ঝগড়া করতে নেই, আপনার মন খারাপ করে কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে থাকতে নেই। সব সময় মেইনটেইন করতে হবে আপনার নিজেকে, কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি দর্শকের চোখের আড়ালে চলে গেলেন, তখন ওই আপনার খোঁজ রাখবে না কেউ। চরম জনপ্রিয় বলিউড স্টার শাহরুখ খান নাকি ভয়াবহ ডিপ্রেশনের রোগী। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি মন খারাপ হলে বাথরুমে গিয়ে কাঁদেন। রবিন উইলিয়ামস, দুনিয়াজোড়া সুখ্যাতি যার, মানুষ হাসানোর জন্য তিনি ছিলেন ভয়াবহ বিষণ্ন একজন মানুষ। এটাই হয়তো নিয়তি। যার কাঁধে জোয়াল মানুষকে বিনোদিত করার, তিনিই বিনোদনহীন একজন অদ্ভুত চিড়িয়া। প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকি নক্ষত্রদের দিতে। তাঁদের পদক্ষেপ অনুসরণ করি অন্ধের মতো।

প্রায়ই পত্রিকায় সংবাদ আসে দুস্থ শিল্পীর জন্য কনসার্ট কিংবা অমুক দুস্থ শিল্পীর জন্য সাহায্য চাই। শুনতে এবং দেখতে খুব খারাপ লাগে। কেন? কেন এই দৈন্য? কিন্তু এটাই বাস্তবতা। শিল্পীর সত্যিই কোনো পেনশন নেই এ দেশে। যত দিন আছেন, যত দিন আপনার খাওয়া আছে, তত দিন আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে জাতি। যেদিন আপনি অতীত হয়ে গেলেন, সেদিনই মুখ তুলে কেউ দেখবে না আপনাকে। সালেহ আহমেদ, যিনি একসময়ের প্রবল শক্তিমান অভিনেতা, তিনি এখন নিজ গৃহে পড়ে আছেন অসুস্থ অবস্থায়, কেউ নেই তাঁর খোঁজ নেওয়ার। এ তালিকা অনেক দীর্ঘ। তাঁদের কথা নাই-বা বললাম। যা বলার জন্য লিখছি, তা হলো বর্তমান অবস্থা নিয়ে। আমরা যাঁরা সময় ধরে টেলিভিশন আঁকড়ে আছি, তাঁরা জানি যে বর্তমান সময়ে টেলিভিশন কর্তারা এবং মার্কেটিংয়ের মানুষেরা শুধু প্রধান চরিত্র ধরে বলে দেন যে আমার ঈদের নাটকে অমুক-তমুককে লাগবে এবং কখনো কখনো তাঁরাই নির্ধারণ করে দেন তাঁদের পারিশ্রমিক। এসব পারিশ্রমিক এতটাই চড়া যে তখন স্টার কাস্টদের পারিশ্রমিক দিয়ে আর কোনো টাকাই থাকে না নির্মাতাদের কাছে। তাঁরা কী করবেন? তাঁদের দিকে না তাকালে তো হবে না। একজন তাজিন আহমেদ কিংবা অন্য কেই কিন্তু এক দিনে তৈরি হননি। তাঁর এই অকালপ্রয়াণে আমাদের বিস্তারিত পরিকল্পনা বেশ প্রভাব ফেলেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এই ইন্ডাস্ট্রি মানে বাংলাদেশের নাটক, সিনেমা, শিল্প, সাহিত্য—খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বদরবারে। একটু যত্ন দরকার। একটু মনোযোগ দরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
অনেক কথা মনের ভেতর জমা হয়ে আছে। আজ শুধু ট্রেইলার দিলাম। পুরো সিনেমা অন্য কোনো দিন প্রকাশ করব হয়তো। পেনশনবিহীন শিল্প এবং শিল্পীরা বেঁচে থাকুক। বেঁচে থাকুক বাংলাদেশ। আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। হয়তো আবারও দেখা হবে আমার নতুন গল্প, সিনেমা নিয়ে।

অনিমেষ আইচ: নির্মাতা