আমি সময় নষ্ট করেছি কম: ফেরদৌসী মজুমদার

ফেরদৌসী মজুমদার
ফেরদৌসী মজুমদার
>

বাংলাদেশের মঞ্চ ও টেলিভিশন জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি ফেরদৌসী মজুমদার। গতকাল ছিল তাঁর ৭৫তম জন্মদিন। জন্মদিনে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

৭৫তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। একটা দীর্ঘ সময় নান্দনিকভাবে কাটিয়ে দিলেন, পেছন ফিরে যখন তাকান, কেমন লাগে?
কোথা দিয়ে সময় চলে গেল, বুঝতেই পারিনি। অনেকে বলেন, সময় চলে গেল, কিছুই করা হলো না। আমার সেটা মনে হয় না। আমি সময় নষ্ট করেছি কম। আমি অভিনয়টাকে ভালোবাসি, সংসার করতে ভালোবাসি, বাচ্চাদের পড়াতে ভালোবাসি। তিনটি ভালোবাসার জিনিস একসঙ্গে করেছি। এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। যখন দেখি, মানুষ ভালোবাসছে, শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, নন্দিত করছে, তখন মনে হয় যে, না, কিছু তো করেছি। মানুষকে আনন্দ দিয়েছি। মনে একটু শান্তি হয়। এ ছাড়া তেমন কিছু না। এখনো কাজ করে যাচ্ছি। আমি যে এখনো এক্কেবারে ফুরিয়ে যাইনি, সে জন্য বিধাতার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

কোনো আফসোস আছে?
একটা আফসোস হয়, আবার যদি সেই জীবনটাতে ফিরে যেতে পারতাম! একেবারে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে সব করে, দুই বালতি কাপড় কেঁচে, ঘর ঝাড়ু দিয়ে, মুছে, পার্ট মুখস্থ করে, একই শো দুইবার দুই জায়গায় করে বাড়ি ফিরে আসতাম। সেই যৌবনে, সেই কৈশোরে যদি ফিরে যেতে পারতাম! এটা ঠিক বয়স বেড়েছে, শক্তি কমেছে। কিন্তু বয়স বাড়লে কাজ করার ইচ্ছা তো কমে না। সে জন্য মাঝে মাঝে মনে হয়, আহা, যদি আরেকটু শক্তি পেতাম, আরেকটু সময় পেতাম! যখন গান শুনি, মনে হয় আহা গান কেন শিখলাম না। তাহলে তো এই বয়সেও গাইতে পারতাম। তবে বিধাতাকে বলি, চলতে চলতেই যেন আমি চলে যাই। কাউকে কষ্ট দিতে চাই না।

আপনাদের সময় মঞ্চের প্রতি যে একনিষ্ঠতা ছিল, নতুনদের মধ্যে সেটার অভাব দেখেন কি না?
ওদেরও দোষ নেই তো। পৃথিবীটা আগের মতো নেই। আমাদের সময় আমরা আনন্দের সঙ্গে কাজ করেছি। এখন একজন চাকরিবাকরি করে, তারপর আসে। আসলে সম্ভব হয় না। অভিনয়ে মহড়ার কোনো বিকল্প নেই। সেটা না হলে অভিনয়টা সেই মানের হয় না। আমরা টেলিভিশনের কাজও করেছি এক মাসের মহড়া করে। এখন সবাই এটা হাস্যকর ভাববে। এখনো যদি আমি কিছু করি, চেষ্টা করি দু-চারবার মহড়া করে নিতে। এখনকার যারা, তারা চাইলেও সময় দিতে পারে না। এখন আমরা রাস্তাতেই থাকি চার ঘণ্টা। তাই সামাজিক জীবনও চলে গেছে আমাদের। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, কারণ আমি ওই সময়ে কাজ করেছি, যখন জীবনটা এত কঠিন ছিল না।

আপনি বাচ্চাদের যখন পড়ান, তখন কি অভিনয় কাজে লাগে?
অবশ্যই লাগে। আমরা তো সবাই অভিনেতা। আপনিও অভিনেতা, কিন্তু সেটা টের পান না। কমবেশি অভিনয় আমরা সবাই করে যাচ্ছি। শেক্‌সপিয়ারের কথাটাই ঠিক, পুরো পৃথিবীটাই একটা রঙ্গমঞ্চ। আমরা কিন্তু এখানেই লাফঝাঁপ করছি। অভিনয়গুণটা যদি থাকে, তাহলে কাউকে কিছু বোঝানো সহজ হয়। অভিব্যক্তি দিয়ে বাচ্চাদের যখন পড়াই, তখন বুঝতে পারি যে বাচ্চারা পছন্দ করছে। হাসতে হাসতে পড়া আত্মস্থ করছে। ওরা কিন্তু আমাকে দেখেনি কখনো। দু-তিন বছর আগে সানবিমস স্কুলের প্রিন্সিপালের অনুরোধে যখন সেখানে মেরাজ ফকিরের মা করি, বাচ্চারা অবাক হয়ে গেছে। তখন মনে হয়েছিল, কিছু একটা করেছি। না হলে এদের ভালো লাগবে কেন? অভিনয় সব ক্ষেত্রেই লাগে। সংসার করতেও একটুখানি লাগে (হাসি)। অভিনয়ে আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, জীবন থেকে নিয়েই আমি অভিনয় করেছি।

এমন কোনো চরিত্র আছে, যেটা করার লোভ ছিল, কিন্তু করতে পারেননি?
হ্যাঁ, ইচ্ছা ছিল সাদামাটা মুখে একটা খুনির চরিত্র করব। সে একজন নারী, যাকে বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, কিন্তু ভেতরে সে আসলে ঠান্ডা মাথার খুনি।

আপনার প্রিয় নাট্যকার কে?
মামুনুর রশীদ ও পান্থ শাহরিয়ার। আমেরিকান নাট্যকার লি ব্লেসিংয়ের দ্য ইনডিপেনডেন্ট নাটকটি মুক্তি নামে ভাষান্তর করেছিলেন মিজারুল কায়েস। অসাধারণ সেই অনুবাদ। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর আরও নাটকে অভিনয় করার ইচ্ছা ছিল।

রামেন্দু মজুমদার স্বামী হিসেবে কেমন?
যা ভেবেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি আমার জন্য করেছেন। দিনে দিনে তাঁর ওপর আমি আরও নির্ভর হয়ে পড়ছি।