নাটক নির্মাণে সমাজ-সতর্কতা খুব দরকার

পারুল লতা নাটকের দৃশ্যে আফজাল হোসেন ও তিশা
পারুল লতা নাটকের দৃশ্যে আফজাল হোসেন ও তিশা

বাংলাভিশনের নিয়মিত সংগীতানুষ্ঠান ‘সুরের আয়না’ প্রচারিত হলো ৬ জুলাই বিকেল ৬টায়। এ দিন শিল্পী ছিলেন শামীমা পারভীন শিমু ও জয়িতা সাহা। উপস্থাপনায় ছিলেন শিল্পী ফাহমিদা নবী।

এ দিন দুই প্রজন্মের দুজন শিল্পীর পরিবেশনায় অনুষ্ঠানটি পেয়েছিল নতুন মাত্রা। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান এবং তার মাঝে দুয়েকটি নিজের গান পরিবেশনার মাধ্যমে শিল্পীদ্বয় অনুষ্ঠানটিকে করে তুলেছিলেন বৈচিত্র্যময়। দুজনের উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার মধ্যে জয়িতা সাহা গেয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’; নজরুলসংগীত ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’ এবং আধুনিক ‘হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছ তুমি’ ইত্যাদি। অন্যদিকে শামীমা পারভীন শিমু গেয়েছেন নজরুলসংগীত ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়’; নিজের গান ‘ভুলতে পারিনি তাই এসেছি তো পথ ভুলে’ ইত্যাদি।

আলাদাভাবে দুজনের বৈশিষ্ট্য আলোকপাত করতে গেলে বলতে হয়, শামীমা পারভীন শিমুর কণ্ঠ সুরেলা, আর গান করেন একটু উঁচু পর্দায়। উঁচু পর্দায় গান করার কারণে সুরে মাঝে মাঝে অনাবশ্যক কম্পন অনুভূত হয়। যে কারণে তাঁর পরিবেশনা মনে হয় হারানো দিনের শিল্পীদের মতো। অন্যদিকে জয়িতার পরিবেশনা ঠিক বিপরীত। তাঁর কণ্ঠও সুরেলা এবং মিষ্টি। পরিবেশনা ধীরস্থির ও আন্তরিকতাপূর্ণ। অনুষ্ঠানের যে দিকগুলো দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো, বাদ্যযন্ত্রের বাহুল্যবর্জিত এবং গানের নির্বাচনের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের সুসমন্বয়। ফাহমিদা নবীর উপস্থাপনাও ছিল একটু ভিন্নতর। খুব সাজানো-গোছানো ও আড়ম্বড়পূর্ণ কথা তিনি বলেননি, যেটুকু বলেছেন মনে হয়েছে আন্তরিকতাপূর্ণ ও অকৃত্রিম। তবে অনুষ্ঠানটি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে এটি দর্শকের অংশগ্রহণে সরাসরি সম্প্রচারিত হলে হয়তো হতো আরও সফল এবং আরও আকর্ষণীয়।

এবারে নাটক। ৬ জুলাই রাত ৮টায় আরটিভিতে প্রচারিত হলো নাটক (অ) সাধারণ। রচয়িতার নাম খুঁজে পাইনি, পরিচালনা শুভ রায়হান। অভিনয়ে লুৎফর রহমান জর্জ, সজল, স্পর্শিয়া প্রমুখ।

নাটকের গল্পটি হলো, সজল ও মামুন দুই বন্ধু। দুজনই তাদের প্রেমিকার সঙ্গে নিয়মিত ঘোরেফেরে। শহরে হত্যা-আতঙ্ক নিয়ে চিন্তিত সজলের প্রেমিকা স্পর্শিয়া। আর মামুন অস্থির টাকার জন্য। মামুন তার প্রেমিকা সুমিকে চাপ দেয়, এমনকি ব্ল্যাকমেইলও করতে চায় টাকার জন্য। তাতেও ব্যর্থ হয়ে সে একদিন তার বন্ধু সজলের বাসা ও গাড়ির চাবি নিয়ে প্রেমিকা সুমিকে অপহরণ করে এবং তার বাবার কাছে টাকা দাবি করে। তারপর বাইরে থেকে খাবার কিনে বাসায় ফিরে দেখে বন্দী সুমি নিহত ও রক্তাক্ত। এরপর স্পেশাল ব্রাঞ্চ প্রথমে মামুন ও পরে সজলকে গ্রেফতার করে এবং তাদের জেরার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে সজলই খুনি। সজল স্বীকার করে শুধু সুমিকেই নয়, তার বাবার হাতে মায়ের খুনের বিচার না পেয়ে একের পর এক খুন করে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সে-ই। এই হলো গল্প।

এককথায় বলব, অপরাধজগৎ নিয়ে গল্প যেমন হয়, এটি ঠিক তেমনই। এসব গল্পের শক্তির জায়গাটি হলো দর্শকের বিশ্বাসযোগ্যতা ও কৌতূহল। নাটকটির উভয় ক্ষেত্রেই ধরা পড়েছে বিশেষ দুর্বলতা। যেমন, খুনের আতঙ্ক নিয়ে সজলের প্রেমিকা যখন সংবাদপত্রের কথা বলেছে, তখন সজল যে ভাষায় ও যেভাবে উত্তর দিয়েছে তা শুনেই দর্শক বুঝে গেছে, সজলই হবে সেই রহস্যময় খুনি। এ ছাড়া মামুন চরিত্রটিকে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেননি নির্মাতা। মামুন ছাত্রজীবনেই কেন এমন টাকা টাকা করবে এবং সেই টাকার জন্য নিজ প্রেমিকাকেই অপহরণ করবে কেন, এটা তো সে অন্য কাউকে করতে পারত। অন্যদিকে দুদিন আগে যে প্রেমিক সুমিকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইল, সে ডাকল আর তার সঙ্গে সুমি লংড্রাইভে এবং নির্জন বাসায় ডেটিংয়ে চলে গেল, এটি বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।

অভিনয়ের কথা বললে, সজলের শরীরী ভাষা মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ঠেকেছে, তবে শেষাংশটুকু ভালো ছিল। আর স্পর্শিয়ার উচ্চকণ্ঠ ছিল অত্যন্ত কর্কশ ও বিরক্তিকর। এ ছাড়া বাকিদের অভিনয় ছিল গতানুগতিক। আর নামকরণটি কেন (অ) সাধারণ রাখা হলো এবং এভাবে লেখা হলো কিছুই বুঝলাম না। শেষে বলব, গণমাধ্যমে এ ধরনের হত্যা, অপহরণ নিয়ে নাটক করা হলে তার ভয়াবহ পরিণতিটিও দেখানো উচিত, সামাজিক সতর্কতার কারণেই। যেটা এ নাটকে দেখানো হয়নি।

এবারে আলোচনা শেষ করব একটি পরিচ্ছন্ন নাটকের বিবরণ দিয়ে। নাটকটির নাম পারুল লতা। রচনা প্রসূন রহমান, পরিচালনা তপু খান, অভিনয়ে আফজাল হোসেন, তিশা প্রমুখ। নাটকটি প্রচারিত হলো এনটিভির প্রতিষ্ঠাদিবস ৩ জুলাই রাত ৯টা ৫ মিনিটে।

নাটকের বিষয়, একজন কবি ও তাঁর তরুণী ভক্তপাঠিকার অনুরাগ। কবির ভূমিকায় আফজাল হোসেন এবং ভক্ত পাঠিকার ভূমিকায় তিশা চমৎকার অভিনয় করেছেন। কবিতার প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ যে কালক্রমে কীভাবে কবির প্রতি ভালোবাসায় উত্তীর্ণ হতে পারে তা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক ও নির্মাতা। নাটকের নামকরণ এবং গল্পের বুননেও ছিল কালোত্তীর্ণ আবহ। সংলাপ এবং চিত্রনাট্যও ছিল প্রশংসনীয়। পটভূমির সঙ্গে মিল রেখে স্থান নির্বাচন ও চিত্রধারণ ছিল আকর্ষণীয়।

তবে চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের মনে হয়েছে পারুল লতাকে আরও অন্ধ-আবেগী দেখানো উচিত ছিল। কারণ, কবিতা ভালোবাসতে গিয়ে যখন সে অসমবয়সী কবিকে ভালোবেসে ফেলে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তখন তাকে অন্ধ-আবেগী ছাড়া আর কীই বা বলা যায়। আরেকটি বিষয় কিছুটা বিসদৃশ মনে হয়েছে, তা হলো আবহসংগীত। এত পরিচ্ছন্ন একটি নাটকও মাঝে মাঝে বিরক্তিকর মনে হয়েছে আবহসংগীতের কারণে। লবণ অবশ্যই রান্নায় স্বাদ বাড়ায়, কিন্তু অতি লবণের ব্যবহারে যে কী হয় আমরা সবাই জানি। নাটকটিতে আবহসংগীতের ব্যবহার ছিল অনেকটা ওই অতি লবণ ব্যবহারের মতোই।