এখনো চলে মাটির রেকর্ড

সুর বীণা দোকানে সাজানো ক্যাসেট ও গ্রামোফোন রেকর্ড
সুর বীণা দোকানে সাজানো ক্যাসেট ও গ্রামোফোন রেকর্ড

খবরটি পাওয়া যায় এক গানপাগল মানুষের কাছ থেকে। এই নগরে এখনো বিক্রি হয় গ্রামোফোন রেকর্ড! অবিশ্বাস্য। খোঁজ নিয়ে হানা দিই। দু-দুদিন বন্ধ পাওয়া যায় দোকানটি। আশা ঘুচে যায়—ইউটিউব ও অনলাইনের এই যুগে এ গুজব হতে পারে!

সুর বীণার ভেতরের দৃশ্য
সুর বীণার ভেতরের দৃশ্য

তবুও তৃতীয় দিনে যাওয়া। গ্রামোফোন রেকর্ড দেখার একটা আশাও মনে উসখুস করছিল। অবশেষে পাওয়া গেল। সারি সারি সাজানো গানের ক্যাসেট। আছে সিডি ও ডিভিডি। সাজানো আছে দু-দুটো এলপি প্লেয়ার ও ক্যাসেট প্লেয়ার। আর ঠিক তার পাশের তাকগুলোতে কাগজে মোড়ানো গ্রামোফোন রেকর্ড; যাকে মাটির রেকর্ড বলছিলেন দোকানি।

সারি সারি ক্যাসেট, সিডি, গ্রামোফোন রেকর্ড থাকলেও এক একটি জিনিসের আছে এক একটি গল্প। মধ্যবয়সী কাঁচা-পাকা চুলের দোকানি মুজিবুস সামাদ। এ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটির মালিকও তিনি। কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, এখনো কি এই ব্যবসা চলে? কারা কেনেন? উনি বলতে থাকলেন এক এক করে।

দোকানে রাখা ক্যাসেটগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, এগুলো নতুন নয়। পুরোনো ক্যাসেটই সংগ্রহ করে রাখা। তবে পুরোনো ক্যাসেট কেনেন কারা? মুজিবুস সামাদ বললেন, এখন ইউটিউব-অনলাইনে খুব সহজেই পুরোনো গান পাওয়া যায়। তবে একটা গানের মূল স্বাদ ওখান থেকে পাওয়া যায় না। অনেকেই তাই সঠিকভাবে গানটি শুনতে এই ক্যাসেট কিনতে আসেন। ক্যাসেট থেকে গানগুলো কনভার্ট করে অনলাইনে যা পাওয়া যায়, সেগুলো ঠিক মূল গানের মতো শুনতে ভালো লাগে না। তাই পুরোনো এই ক্যাসেটই সংগ্রহ করেন, নির্দিষ্ট এমন সংগীতপ্রেমীদের কাছে ক্যাসেটগুলো বিক্রি করেন তিনি।

বাংলা থেকে শুরু করে হিন্দি, উর্দু গানের ক্যাসেট আছে তাঁর সংগ্রহে। পাশেই রাখা সিডি ও ভিসিডি। এগুলোর আবেদনও ক্যাসেটের মতোই। প্রশ্ন করা হয়, তবে গ্রামোফোন রেকর্ড কারা কেনেন? মুজিব জানান, অনেক গ্রাহক এখনো গ্রামোফোন রেকর্ড শুনতে ভালোবাসেন। তাঁরা কিনতে আসেন। এখন তো গান ইউটিউবে পাওয়া যায় ঠিক, কিন্তু গ্রামোফোন রেকর্ড শোনার নস্টালজিয়া অনেকেই ভুলতে পারেন না। একেক মাধ্যমে শোনার মজা তো আলাদা। তাকে সাজানো হিন্দি গানের গ্রামোফোন রেকর্ড। আছে বাংলাদেশের আব্বাস উদ্দীন, আবদুল আলীম, ভারতের লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, পাকিস্তানের নুরজাহানের মতো শিল্পীদের গান। আছে হিন্দি ছবি পাকিজা, দুলারির মতো ছবির গান।

সবচেয়ে চমকে যাওয়ার ব্যাপার হলো, এই দোকানেই আছে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর গানগুলোর গ্রামোফোন রেকর্ড, জসীমউদ্‌দীনের ‘ভাটির দ্যাশের কাজল মায়ায়’-এর লং প্লে। তবে মুজিব বলেন, সবকিছুই তাঁরা বিক্রি করেন না। কিছু থাকে এন্টিক হিসেবে। যেমন কনসার্ট ফর বাংলাদেশের গানগুলো ঠিক বিক্রির জন্য না। এগুলো আর্কাইভ করে রাখার জন্য। তবে তাঁরা হিন্দি গানের গ্রামোফোন রেকর্ড নিয়ে আসেন ভারত থেকে। বাংলা গান খুব একটা পাওয়া যায় না।

মুজিবুস সামাদের সঙ্গে গল্প চলে। চলতে থাকে গান। তখন বাজছিল ‘চম্পা শোন শোন ফাল্গুন এসেছে’ গানটি। মুজিব বলে চলেন তাঁর গানের প্রতি আগ্রহের কথা। শখের বসেই ২০১০ সালে শুরু করেছিলেন এলিফ্যান্ট রোডের এই সুর বীণা দোকানটি। এরপর একটা সময় ফেরি করেও নাকি বিক্রি করা হতো তাঁদের ক্যাসেট। কিন্তু ধীরে ধীরে ভাটা পড়ে এই ব্যবসায়। অনেক দোকানই উঠে গেছে। তাঁদের এ দোকানটিসহ হাতে গোনা দু-একটি দোকান আছে সিডি-ভিসিডির। তাঁরাও ভাবছেন এর পাশাপাশি আরেকটি দোকান দেবেন। প্রশ্ন তুলি এ দোকানটি কি তবে উঠে যাবে? মুজিবুস সামাদের উত্তর, ‘না না। কী বলেন? গান তো ভালোবাসি আমি। এটা থাকবে। আমার মতো অনেকেই তো আছেন মূল রেকর্ড শুনতে ভালোবাসেন। তাঁরা আসবেন, মাটির রেকর্ড কিনবেন আরেকবার নস্টালজিক হতে।’