যেন পারিবারিক সম্পর্ক

নাট্যকর্মী বিথুন আহমেদ, আরিফ হোসেন, ফেরদৌস ইকরাম ও বাহার সরকার। মহড়া কক্ষের বাইরেও তারা বন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
নাট্যকর্মী বিথুন আহমেদ, আরিফ হোসেন, ফেরদৌস ইকরাম ও বাহার সরকার। মহড়া কক্ষের বাইরেও তারা বন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

অফিস শেষে সন্ধ্যায় মহড়াকক্ষে হাজির নাট্যকর্মী বাহার সরকার। প্রথম দিনে হয়তো কেউই অতটা পরিচিত নন তাঁর কাছে। দিনে দিনে মহড়ার এই অপরিচিত মুখগুলোই হয়ে ওঠে কাছের মানুষ। সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে যায় বন্ধুত্বে। মহড়াকক্ষের বাইরেও নাটকের ওই বন্ধুদের সঙ্গেই চলে আড্ডা, সুখ-দুঃখের ভাগ-বাঁটোয়ারা। শিল্পকলা একাডেমির বাইরে চায়ের দোকানে কিংবা নাটক সরণির ফুচকার দোকানে আড্ডার ঝড় ছোটে নাটকের এসব বন্ধুর মধ্যে। তখন তাঁরা কেউ নাট্যকর্মী নন, কেবলই বন্ধু।

মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য বাহার সরকার। একসঙ্গে কাজ করতে করতেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আরিফুর হোসেন ও বিথুন আহমেদের সঙ্গে। চাকরি, কাজ আর অন্যান্য ব্যস্ততায় নিয়মিত নাটকের কাজ করতে না পারলেও নাটকের বাইরে ঠিক আড্ডায় দেখা হয় তাঁদের। বাহার বলেন, ‘প্রথম থিয়েটারে আসি তখন কেউই পরিচিত ছিল না। ধীরে ধীরে আসলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সারা দিন কাজের শেষে মহড়াকক্ষে একসঙ্গে কাজ করতে করতে একটা পারিবারিক আবহ তৈরি হয়। থিয়েটার না করতে পারলেও সম্পর্কটা থেকে যায়।’

থিয়েটারের সদস্য সুব্রত মণ্ডল। নাটকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে। সেই বন্ধু এখন দেশের বাইরে। মহড়াকক্ষে দেখা হয় না। কিন্তু সম্পর্কটা এখনো রয়ে গেছে আগের মতো। তাঁর মতে, থিয়েটার যেহেতু ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয়, তাই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও অনেক গভীর হয়। মানুষের প্রতি ভালোবাসার জায়গাটা দৃঢ় হয়। যার কারণে মানুষটি অনেক দূরে চলে গেলেও বন্ধুত্বটা থেকে যায় চিরদিন।

থিয়েটারের কাজটাই একটা ‘টিমওয়ার্ক’-এর। এখানে কাজ করতে গেলে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়। প্রাচ্যনাট নাট্যদলের সদস্য রানা এমনটাই মনে করেন। তাঁর মতে, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে থিয়েটার করেন, তাঁরা মূলত বন্ধুত্বের জন্যই করেন। থিয়েটার করতে করতেই বন্ধুত্বটা তৈরি হয়ে যায়। থিয়েটার করতে গেলে নিজেদের মধ্যে ত্যাগের বিষয়টা তৈরি হয়। আর ত্যাগ যেখানে থাকে সেখানে বন্ধুত্ব অনেক বেশি গাঢ় হয়। শুধু বন্ধুত্বের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময় সে সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্কেও রূপ নেয়। দেখা যায় প্রথমে মহড়া, তারপর আড্ডা, তারপর বাসায়ও আসা-যাওয়া শুরু হয় পরিবারের সদস্যের মতো। তখন থিয়েটারের পরিচয় ছাপিয়ে বন্ধুত্বের পরিচয় উঠে আসে।

এদিকে বটতলা নাট্যদলের নাট্যকর্মী মাহবুব মাসুম তো থিয়েটারের বন্ধুদের নিয়েই বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। বন্ধুদের নাম বললে কড় গুনে গুনে থিয়েটারের বন্ধুদের নামই বললেন তিনি। মাসুমের ভাষ্য, ‘আমি নয় বছর যাবৎ নাটক করছি। যেহেতু থিয়েটার টিমওয়ার্ক। কাজ করতে গেলে সবাই কাছাকাছি থাকব। আমরা থিয়েটার যারা করি, অফিসের পরে পরিবারের থেকেও মহড়াকক্ষে বেশি সময় দিই। সুতরাং এখানেই বন্ধুত্বটা তৈরি হওয়াটা সহজ। আর এখানে যাদের সঙ্গে একবার বন্ধুত্ব হয়, অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। হৃদয়ের অনেক বেশি কাছাকাছি থাকে এই মানুষগুলো। এখন আমার যেসব বন্ধু আছে তারা এই থিয়েটারেরই। নাটকে কেউ নিয়মিত কেউ অনিয়মিত তবু বন্ধুত্ব আছে ঠিকঠাক। আর যেহেতু কাজটা অনেক বেশি আত্মিক, তাই সম্পর্কটাও একদম পারিবারিক সম্পর্কের মতো।’

থিয়েটারের মহড়ায় নাটকের জন্য শরীর ও মন তৈরি করতে বিভিন্ন গেম করানো হয়। তার মধ্যে ‘ট্রাস্ট গেম’ একটি। ট্রাস্ট গেমের মাধ্যমে একজন নাট্যকর্মী আরেকজন নাট্যকর্মীকে বিশ্বাস করতে শেখেন। এই বিশ্বাস শুধু গেমেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এর মাধ্যমে আস্থা তৈরি হয় মনে। তারপর সেই আস্থা থেকেই দাঁড়িয়ে যায় সম্পর্ক। সে সম্পর্ক কেবল থিয়েটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে যায় থিয়েটারের বাইরেও। যেন এক পারিবারিক আবহ।