৫০ শিল্পী নিয়ে ছবি আঁকার মহাযজ্ঞ!

প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি ৫০ জন শিল্পী অংশ নিয়েছে এই আর্ট ক্যাম্পে। ছবি: প্রথম আলো
প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি ৫০ জন শিল্পী অংশ নিয়েছে এই আর্ট ক্যাম্পে। ছবি: প্রথম আলো

ছবি আঁকাআঁকির এক মহাযজ্ঞ বিশাল জাতীয় চিত্রশালার লবিটি। ৩ ফুট বাই ৩ ফুট বর্গাকৃতির ক্যানভাস আর রং নিয়ে মেতেছিলেন ৫০ জন শিল্পী। সবাই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি। কেউ এসেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কেউ রাজশাহী, সিলেট, দিনাজপুর, নেত্রকোনা ও নাটোর থেকে। কারও বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। গত বৃহস্পতিবার থেকে আজ শনিবার, প্রতিদিন একটি করে তিনটি ছবি এঁকেছেন প্রত্যেকে। মোট ১৫০টি ছবি আঁকা হয়েছে।

প্রথমবারের মতো দেশের এমন ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবনবৈচিত্র্য রংতুলির ছোঁয়ায় মূর্ত হয়ে উঠছে ক্যানভাসে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি ৫০ জন শিল্পী নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া এ আর্টক্যাম্প আজ শনিবার শেষ হয়েছে।

রীতিমতো উৎসবমুখর ছিল এ তিন দিনের পরিবেশ। সকাল থেকে সন্ধ্যা, ছবি আঁকা, আড্ডা, চা-কফিতে দারুণ কেটেছে শিল্পীদের। কখনো নিজে ছবি এঁকেছেন, কখনো আবার অন্যের ছবির পাশে গিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। এ সময়টায় যতবার চিত্রশালা প্লাজায় গেছি, বিশাল প্লাজায় যেদিকে দৃষ্টি গেছে, মুগ্ধ হয়েছে মন। অপূর্ব সে দৃশ্য!

ক্যানভাসে যে যাঁর দেখা, শোনা আর জানার অভিজ্ঞতা থেকে ছবি আঁকছেন। কোনোটিতে মানুষ, কোনোটিতে যাপিত জীবন। এক জাতিসত্তার শিল্পী এঁকেছেন আরেক জাতিসত্তার ছবি। যেমন শিল্পী তিতাস চাকমার ক্যানভাসে দেখা গেল দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ‘নাগদী’ সম্প্রদায়ের জীবনযাপনের চিত্র। তিতাস চাকমা গিয়েছিলেন নাটোরে। জেলায় এ সম্প্রদায়ের মাত্র তিনটি পরিবার আছে। তারাই ধরে রেখেছে এই জাতিসত্তার শিকড় ও সংস্কৃতি। শিল্পী তিতাস চাকমাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘একদিন হয়তো নাগদী সম্প্রদায়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো হরিয়ে যাবে। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের এই কাজের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে সবাই জানতে পারবে।’

৫০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবনবৈচিত্র্য রংতুলির ছোঁয়ায় মূর্ত হয়ে উঠছে ক্যানভাসে। ছবি: মাসুম আলী
৫০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবনবৈচিত্র্য রংতুলির ছোঁয়ায় মূর্ত হয়ে উঠছে ক্যানভাসে। ছবি: মাসুম আলী

উদর শংকর চাকমা এঁকেছেন ‘চবর’ সম্প্রদায়ের একজন নারীর প্রতিকৃতি। নয়ন ত্রিপুরা এঁকেছেন মালো নৃগোষ্ঠীর দলীয় নৃত্য পরিবেশনার একটি চিত্র। জেনি মং চৌধুরী এঁকেছেন বর্মণ সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ যুগলের ছবি। মুম্বিনী দেওয়ান বলেন, ‘মাহাতো সম্প্রদায়ের বর্তমান অবস্থান, ঘরবাড়ি, তাদের বাড়ির আঙিনায় পালিত প্রাণী—এসব নিয়ে আমি ছবি আঁকার চেষ্টা করছি। এই কাজের মাধ্যমে তাদের জীবনচিত্র সম্পর্কে সবাই জানতে পারবে, এটাই আমাদের সার্থকতা।’

কথা হলো আর্ট ক্যাম্পটির প্রধান সমন্বয়কারী শিল্পী কনকচাঁপা চাকমার সঙ্গে। তিন দিন সারাক্ষণ থেকে নিজেই পুরো আয়োজনটি তদারক করেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন তরুণ শিল্পীদের। কনকচাঁপা চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, এক সম্প্রদায়ের শিল্পীরা আরেক সম্প্রদায়ের ছবি এঁকেছেন। ইচ্ছা করেই এক এলাকার শিল্পীদের দূরে অন্য এলাকায় পাঠানো হয়েছে। এতে করে তাঁদের মাঝে পরস্পর যেমন অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়েছে, তেমনি নিজেও সমৃদ্ধ হয়েছে নতুন একটি সম্প্রদায়ের বিষয়ে জেনে।

নয়ন ত্রিপুরা এঁকেছেন মালো নৃগোষ্ঠীর দলীয় নৃত্য পরিবেশনার একটি চিত্র
নয়ন ত্রিপুরা এঁকেছেন মালো নৃগোষ্ঠীর দলীয় নৃত্য পরিবেশনার একটি চিত্র

এটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিল্পীদের নিয়ে সবচেয়ে বড় আর্ট ক্যাম্প। এর আগে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিল্পীদের নিয়ে তাদের জীবনচিত্রের ওপর এত বড় আর্ট ক্যাম্প হয়নি, এমনটিই জানালেন কনকচাঁপা চাকমা। তিনি বলেন, ‘শিল্পকলা একাডেমি থেকে এই আর্ট ক্যাম্প আমাকে এককভাবে করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যাঁরা বিভিন্ন ক্ষুদ্র জীবনসত্তার শিল্পী আছেন, তাঁদের একটা সুযোগ দেওয়া দরকার। এ জন্যই ৫০ জন শিল্পীকে নিয়ে এই আয়োজন। ভালো লাগছে এ জন্য যে এত শিল্পীকে এক আয়োজনে রাখতে পেরেছি।’ তরুণদের মধ্যে অনেক শিল্পী বেশ ভালো করছে, এমন তথ্য দিয়ে কনকচাঁপা চাকমা বলেন, এই শিল্পীদের মধ্য থেকেই ভবিষ্যতে কেউ কেউ খ্যাতিমান শিল্পী হবে এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নিয়ে আরও কাজ করবে। বিলুপ্তপ্রায় ক্ষুদ্র জীবনসত্তার ইতিহাস থেকে যাবে এই কাজের মাধ্যমে।

ক্যানভাসে যে যাঁর দেখা, শোনা এবং জানার অভিজ্ঞতা থেকে ছবি এঁকেছেন। ছবি: মাসুম আলী
ক্যানভাসে যে যাঁর দেখা, শোনা এবং জানার অভিজ্ঞতা থেকে ছবি এঁকেছেন। ছবি: মাসুম আলী

শিল্পকলা একাডেমির পক্ষে ক্যাম্পের বিভিন্ন কাজ দেখাশোনা করেন শিল্পী সুজন মাহবুব। তিনি জানান, এই আর্ট ক্যাম্প আয়োজনের আগে ২১ থেকে ২৩ জুলাই একাডেমি থেকে ৫০ জন শিল্পী কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অঞ্চল পরিদর্শন করেছে। তারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তথ্য-উপাত্ত, স্থিরচিত্র সংগ্রহ করেন, যার ওপর ভিত্তি করে আঁকা হয়েছে চিত্রকর্মগুলো। এসব ছবি ও সংশ্লিষ্ট তথ্য নিয়ে ক্যাটালগ তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আচার, অনুশীলন, জীবনচিত্র ও বিভিন্ন সুকুমার বৃত্তি আমাদের সংস্কৃতির তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। সেসব জাতিগোষ্ঠীর অধিকাংশেরই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলো আজ যথাযথভাবে বিকশিত হচ্ছে না। সেগুলো সংগ্রহপূর্বক চিত্রশিল্পে উপস্থাপনের জন্য এ উদ্যোগ।’

কখনো নিজে ছবি এঁকেছেন, কখনো আবার অন্যের ছবির পাশে গিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। ছবি: মাসুম আলী
কখনো নিজে ছবি এঁকেছেন, কখনো আবার অন্যের ছবির পাশে গিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। ছবি: মাসুম আলী

আর্ট ক্যাম্পে অংশ নিয়েছেন জিংমুন লিয়ান বম, চালাং রিছিল, মংছাইনু মার্মা, রূপশ্রী হাজং, নন্দরাজ চাকমা, খাইদেম সিথি সিনহা, বর্না চাকমা, এশা চাকমা, নমস্তা রেমা, নান্টু চাকমা, তরী রাকসান, অরণ্য কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা, জুলিয়ান বম, সৌমিক দেওয়ান, পিংকু ত্রিপুরা, মংপু মারমা, অংথোয়াই মারমা, মংক্য সিং মারমা, সৌল হাঁচ্চা, জুনান চাকমা, নুমং সিং মারমা, সাপু ত্রিপুরা, বেনিজির সিধু, প্রণব খীসা সজীব, নিশান সিংহ, অরুন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা, বিমলা চাকমা, মুন্না বম, তনিমা চাকমা, নিশা চাকমা, পেনিক চাকমা, ভানরাম বম, মিংকু চাকমা, এভলী চাকমা, আতিয়া মাইবম, লুম্বিণী দেওয়ান, তিতাস চাকমা, নয়ন আলো চাকমা, সুফল চাকমা, অংহ্লা সিং মারমা, অমিত কোচ, লোটাস চাকমা, নিকন চাকমা, চামং উই মারমা, জয়সেন মারমা, জ্ঞান জ্যোতি চাকমা ও দিব্য আলো চাকমা।

উদর শংকর চাকমা এঁকেছেন চবর সম্প্রদায়ের একজন নারীর প্রতিকৃতি
উদর শংকর চাকমা এঁকেছেন চবর সম্প্রদায়ের একজন নারীর প্রতিকৃতি