বাঙালিরা ব্যতিক্রমী ও জিনিয়াস: অক্ষয়

অক্ষয় কুমার
অক্ষয় কুমার
এবার তিনি তপন দাস। এক বাঙালির চরিত্রে দেখা যাবে অক্ষয় কুমারকে। একসময় ঢাকা ও কলকাতায় থেকেছেন এই বলিউড সুপারস্টার। আজও অক্ষয় এই শহর দুটিকে ভুলতে পারেননি। এই শহর দুটি তাঁকে গোল্ড ছবির ‘তপন দাস’ হয়ে উঠতে অনেকটা সাহায্য করেছে। রীমা কাগতি পরিচালিত এই ছবিতে অক্ষয় ভারতীয় হকি দলের ম্যানেজার। গোল্ড মুক্তি পাবে ১৫ আগস্ট। মুম্বাইয়ের এক পাঁচতারা হোটেলে ২৭ জুলাই প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধি দেবারতি ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিলেন বলিউড সুপারস্টার অক্ষয় কুমার। তাঁর গোল্ড ছবি থেকে ঢাকা ও কলকাতার কথাও উঠে এল এদিন


প্রশ্ন: ঢাকা ও কলকাতায় থেকেছেন আপনি। এই দুটি শহর কি আপনাকে ‘তপন দাস’ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে?

অক্ষয়: আমি ছয় মাসের মতো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় থেকে কাজ করেছি। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় দুই বছর থেকেছি। আমার জীবনে এই শহর দুটির ভূমিকা অনেকখানি। অনেক কিছু শিখেছি এই শহর দুটি থেকে। আর ঢাকা ও কলকাতা আমাকে অবশ্যই গোল্ড ছবির ‘তপন দাস’ হতে সাহায্য করেছে। আগে আমি বাংলাটা বুঝতাম। তবে এখন বাংলা বুঝতে অসুবিধা হয়। ঢাকা ও কলকাতায় কাটানোর অভিজ্ঞতা এই ছবিতে পুরোপুরি ব্যবহার করেছি। গোল্ড ছবিতে আমাকে বাংলা বলতে হয়নি। তবে বাংলা বাচনভঙ্গি ব্যবহার করতে হয়েছে। বাঙালি আদবকায়দা খুব জরুরি ছিল ‘তপন দাস’-এর জন্য। আর এসব করতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

প্রশ্ন: ঢাকা ও কলকাতায় থাকার সূত্রে অনেক বাঙালির সংস্পর্শে এসেছেন। বাঙালিদের চারিত্রিক কোন কোন গুণ আপনাকে আকৃষ্ট করে?

অক্ষয়: এই দুটো শহরের বাঙালিদের মধ্যে খুব মিল আছে। আমার মনে হয় বাঙালিরা অসম্ভব জেদি। তাঁরা যেটা একবার করবেন বলে মনে করেন, সেটা থেকে কিছুতেই বের হতে চান না। এর জন্য তাঁদের সারা জীবন হয়তো চলে যায়। আসলে বাঙালিরা স্বপ্নকে বুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে জানেন। তাঁরা সত্যি ব্যতিক্রমী ও জিনিয়াস। আর বাঙালিরা খুবই আন্তরিক। অন্যকে আপন করে নিতে জানেন।

প্রশ্ন: এই দুটো শহরকে ঘিরে কোনো স্মৃতি...

অক্ষয়: বলা যায়, আমার জীবনের অন্যতম সেরা সময় কাটিয়েছি। আর খাওয়াদাওয়ার কথা কী আর বলব। এই দুটো শহর খাওয়াদাওয়ার জন্য বিখ্যাত। কলকাতার মিষ্টি তো দারুণ। নানান রঙে রঙিন এই শহর দুটি।

প্রশ্ন: ‘রুস্তম’, ‘এয়ারলিফট’, ‘প্যাডম্যান’-এর পর এবার ‘গোল্ড’। ‘কেশরী’ ছবিতেও অভিনয় করছেন। আর এই সব কটি ছবি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। এই ধরনের ছবি করার বিশেষ কোনো কারণ?

অক্ষয়: দেখুন, আমাদের জীবনে হলিউড ছবির প্রভাব বড্ড বেশি। হলিউড ছবির মাধ্যমে আমাদের বদ্ধ ধারণা যে আমেরিকা একমাত্র সব পারে। এলিয়েন আক্রমণ করুক বা সুনামি আসুক অথবা আতঙ্কবাদী হামলা হোক, একমাত্র আমেরিকাই পারে নাকি আমাদের রক্ষা করতে। হলিউডের ছবিগুলো আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে আমেরিকার কাছে সুপার পাওয়ার আছে। এবার আমাদের মানসিকতায় বদল আনতে হবে। আমাদের দেশ কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। আমি চাই আমাদের দেশকে বিশ্বের সেরা হিসেবে প্রমাণ করতে। ভারতে এমন সব রত্ন, যাঁরা ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়ে গেছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমরা কেউ জানি না। এমনকি আমিও জানতাম না। শুধু গুগল সার্চে এই সব মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা জানা যায়। আমি সারা বিশ্বের কাছে দেখাতে চেয়েছিলাম যে একজন ভারতীয় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর নাম গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে লেখা আছে। আর সেই কারণে এয়ারলিফট ছবিটা করি। আমি ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া বানাতে চাই। আমি আমার ছবির মাধ্যমে দেখাতে চাই, ভারতীয়রা অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন।

প্রশ্ন: ‘গোল্ড’ ছবির মাধ্যমে ভারতের কোন উজ্জ্বল দিক তুলে ধরতে চাইছেন?

অক্ষয়: আমরা, অর্থাৎ ভারতীয়রা অলিম্পিকে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে গোল্ড আনি। সালটা ছিল ১৯৪৮। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরের বছরই ইংল্যান্ডে অলিম্পিকের আসর বসেছিল। আর ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড ও ভারত। আমরা ইংল্যান্ডকে হারিয়ে হকিতে সোনার পদক আনি। বলা যায়, এই ম্যাচটা ছিল মালিক ও ভৃত্যের। কিন্তু এই ঘটনা আমরা কেউ হয়তো জানি না। আমি তো জানতামই না। রীমা (ছবির পরিচালক) আমাকে জানায় সেই গৌরবময় ইতিহাসের কথা। এমনকি ১৯৩৬ সালে আমাদের দেশ জার্মানিকেও হকিতে হারিয়েছিল। সেই ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন এডলফ হিটলার। তিনি ভারতীয় হকি দলের খেলোয়াড়কে জার্মানির সেনা দলে যোগদানের কথাও বলেন। গোল্ড ছবির মাধ্যমে আপনারা এক সত্য-সুন্দর ঘটনার কথা জানতে পারবেন।

প্রশ্ন: ‘প্যাডম্যান’, ‘টয়লেট এক প্রেমকথা’ এই সব ছবির মাধ্যমে সমাজের বুকে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ‘গোল্ড’ ছবিটা কি সেই উদ্দেশ্য থেকে করা? মানে হকিকে কি আবার ভারতীয় খেলার দুনিয়ায় সগৌরবে ফিরিয়ে আনতে চান?

অক্ষয়: দেখুন, আমি কখনোই সমাজকে শোধরানোর দায়িত্ব নিইনি। এই সব ছবি করার কারণ কখনো সমাজকে বদলানোর জন্য নয়। তবে হ্যাঁ, আমি গর্বের সঙ্গে বলতে চাই যে আমার ছবির মাধ্যমে সমাজে অবশ্যই কিছুটা বদল এসেছে। এখন খোলা জায়গায় শৌচ করার হার অনেক কমেছে। আগে ৫৪ শতাংশ মানুষের কাছে শৌচাগার ছিল না। এখন সেই হারটা ৩২ শতাংশ। মেয়েরা এখন নিঃসংকোচে নিজেদের শারীরিক সমস্যার কথা বলছে। এবার গোল্ড-এর প্রসঙ্গে আসি। আমি এই ছবির মাধ্যমে জানাতে চাই যে হকি খেলে ভারত প্রথম স্বর্ণপদক এনেছে। আর আমি বলতে চাই, অবশ্যই সবারই কোনো একটা খেলার সঙ্গে থাকা উচিত। তা সে যেকোনো খেলাই হতে পারে। একটা খেলা প্রত্যেকের জীবনে থাকা প্রয়োজন। আজ ক্রোয়েশিয়ার মতো অত্যন্ত ছোট একটা দেশ বিশ্বকাপের ফাইনালে গিয়েছিল। আর এর কারণ, এই দেশের নিয়ম হলো, প্রত্যেক নাগরিককে একটা খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। তা সেই নাগরিক যে বয়সেরই হোক না কেন। খেলাধুলা পারে আমাদের মস্তিষ্কে অক্সিজেনের জোগান দিতে, আমাদের মস্তিষ্ক চিন্তামুক্ত করতে। আর স্পোর্টসের মাধ্যমেই জীবনে শৃঙ্খলা আসে।

প্রশ্ন: কিন্তু খেলাধুলার জন্য আজ সবুজ মাঠের অভাব। কোথাও মনে হয় না সরকারের এই বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত?

অক্ষয়: আমাদের এটাই সমস্যা যে সব সময় আমরা দোষারোপ করতে ব্যস্ত। সরকার কিছু করল না বলে অভিযোগ করতে থাকি। যার করার, সে ঠিকই করবে। আমি রাস্তায় মার্শাল আর্ট করতাম। বান্দ্রার এক মিউনিসিপ্যালটি স্কুলে মার্শাল আর্ট শিখতাম। এখনো জুহুর বিচে গিয়ে জেলেদের সঙ্গে ভলিবল খেলি। তাই সদিচ্ছা থাকলে কোনো কিছু কাউকে আটকাতে পারে না।

প্রশ্ন: ‘গোল্ড’ ছবিতে ‘তপন দাস’ হয়ে ওঠার জন্য কতটা হকি শিখতে হয়েছে?

অক্ষয়: আমি স্কুলে হকি খেলতাম। তবে এই ছবিতে আমি হকি খেলোয়াড় নই বা হকির কোচও নই। আমি ভারতীয় হকি দলের ম্যানেজার। আর আমি একজন মদ্যপ ও প্রতারকও। এই ছবিটা যে মানুষকে ঘিরে, তিনি এ রকমই ছিলেন। তবে আসলে সেই ব্যক্তির নাম তপন দাস নয়।

প্রশ্ন: মৌনি রায়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?

অক্ষয়: এই ছবিতে মৌনি খুবই বিশেষ এবং শক্তিশালী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ‘গোল্ড’-এ ও আমার স্ত্রী। তবে এর থেকে বেশি কিছু বলব না। আর অভিনেত্রী হিসেবে মৌনি দারুণ। টিভির জনপ্রিয় অভিনেত্রী সে। আমি ‘নাগিন’ বলে ওর টিভি ধারাবাহিক দেখেছি।

প্রশ্ন: ‘গোল্ড’ ১৫ আগস্ট মুক্তি পাচ্ছে, ভারতের স্বাধীনতা দিবসে। এই দিনটা ছোটবেলায় কীভাবে কাটাতেন আর এখন কীভাবে কাটান?

অক্ষয়: ছোটবেলায় আমার জন্য সবচেয়ে মজার ছিল যে এই দিনটা ছুটি। সকালে স্কুলে যেতাম আর পতাকা উত্তোলনের পর ছুটে বাড়ি পালিয়ে আসতাম। এখন সেভাবে নিয়ম মেনে কাটাই না। আমাদের কমপ্লেক্সে দুবার পতাকা তোলা হয়েছে। তবে আমার কাছে স্বাধীনতা দিবস বলে আলাদা কিছু নেই। দেশের প্রতি সততা ও শ্রদ্ধা হলো বড় কথা। আর আমার কাছে রোজই স্বাধীনতা দিবস।

গোল্ড ছবির পোস্টার
গোল্ড ছবির পোস্টার


প্রশ্ন: নিজের তারকাখ্যাতি কীভাবে দেখেন?

অক্ষয়: তারকাখ্যাতি এমন একটা জিনিস, যা আজ আছে, কাল না-ও থাকতে পারে। তাই একে এত সিরিয়াসলি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর এটাকে সম্মান করা উচিত। সততার সঙ্গে কাজ করা উচিত।

প্রশ্ন: আগামী প্রজন্মের কাছেও আপনি জনপ্রিয়। এটা কী করে সম্ভব?

অক্ষয়: তা আপনিই বলতে পারবেন। তবে আমি খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ। আর আমি ন্যাচারাল। আমার যা মনে থাকে, তা-ই বলে দিই। তবে আমি খুব ডিপ্লোম্যাটিক। আমি কাউকে আঘাত দিতে চাই না। আর আমাকেও কেউ আঘাত দিক, তা-ও আমি চাই না। এই ২৮ বছরের বলিউড-জীবনে আমি কারও সম্পর্কে কোনো বাজে কথা বলিনি। আপনি খতিয়ে দেখতে পারেন।

প্রশ্ন: আপনার কোন কোন গুণ আপনার ছেলেমেয়ের মধ্যে দেখতে চান?

অক্ষয়: আমি চাই আমার ছেলেমেয়ে ওদের নিজেদের মতো বড় হয়ে উঠুক। আমি কখনোই ওদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। আমি সব অভিভাবককে বলতে চাই, তাঁরা যেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের অযথা চাপ না দেন। আমাদের উচিত শুধু আমাদের সন্তানদের গাইড করা। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, তা দেখিয়ে দেওয়া।

প্রশ্ন: আপনি একটু আগে বললেন প্রত্যেকের খেলাধুলা করা উচিত। আপনার ছেলেমেয়েরাও কি খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত?

অক্ষয়: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমার ছেলে আরভ মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছে। আর মেয়ে রানিং খুব ভালোবাসে। আমাদের কমপ্লেক্সের গ্রাউন্ডে দৌড়ে বেড়ায়।

প্রশ্ন: সাধারণ শেফ থেকে আজ আপনি সুপারস্টার। আপনার জীবন সবাইকে প্রেরণা জোগায়। কোথাও মনে হয় না আপনার জীবনের ওপর বায়োপিক করা উচিত?

অক্ষয়: একদমই না। আমাদের দেশে এত মহান ব্যক্তিত্ব আছেন, তাঁদের ওপর বায়োপিক করা উচিত। তাঁরাই আসল হিরো। অরুণাচলম মুরুগানাত্থামের জীবনের ওপর প্যাডম্যান ছবি করেছিলাম। সাদ্দাম হোসেনের সময় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের প্রাণ যিনি বাঁচান, তাঁর ওপর বায়োপিক করেছি। এই ধরনের মানুষের ওপরই বায়োপিক করা উচিত। আমার ওপর কখনোই নয়।

প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন, ‘ফোর্বস’-এর তালিকায় আপনি ভারতীয় তারকা হিসেবে সবার শীর্ষে। এই সফলতা কেমন লাগছে?

অক্ষয়: আমি জীবনে কখনো এটা ভাবিনি। তবে এখন সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। আমি অভিনয় শিখতে চেয়েছিলাম। আর অভিনয়ের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার পয়সা আমার কাছে ছিল না। তাই আমি এমন একটা বইয়ের সন্ধানে ছিলাম, যা পড়ে অভিনয় শেখা যায়। একদিন চার্চগেট স্টেশনে সে রকমই একটি সেকেন্ড হ্যান্ড বই দেখি। বইটার দাম ছিল ১১৮ টাকা। আর আমার পকেটে ছিল ৭২ টাকা। তাই সেই বইটা সেদিন আর কেনা হয়নি। তবে বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় লেখা একটা বাক্য আজও মনে আছে যে ভালো অভিনেতা হতে গেলে আগে ভালো মানুষ হতে হবে। সেখান থেকে আজ ফোর্বস-এ নাম আসা আমার কাছে অনেক বড় পাওনা।