পাঠাগার থেকে নাটকের মঞ্চ

গোয়ালবাড়ি মোড়ের সেদিনের টিনের ঘরের পাঠাগারটি থেকেই এখন গড়ে উঠতে যাচ্ছে নাটকের নতুন স্টুডিও থিয়েটার মঞ্চ
গোয়ালবাড়ি মোড়ের সেদিনের টিনের ঘরের পাঠাগারটি থেকেই এখন গড়ে উঠতে যাচ্ছে নাটকের নতুন স্টুডিও থিয়েটার মঞ্চ

আশির দশকের শেষভাগ। কয়েকজন তরুণ স্বপ্ন দেখলেন—এলাকায় একটি পাঠাগার করবেন। এবড়োখেবড়ো জমির নিচু এলাকা শনির আখড়ার দনিয়া। সবে বাড়িঘর তোলা শুরু হয়েছে। সেখানেই ১৯৮৯ সালের ২৮ জুলাই গড়ে উঠল দনিয়া পাঠাগার। গোয়ালবাড়ি মোড়ের সেদিনের টিনের ঘরের পাঠাগার থেকেই এখন গড়ে উঠতে যাচ্ছে নাটকের নতুন স্টুডিও থিয়েটার মঞ্চ।

থিয়েটারটিতে একসঙ্গে ৮০ জন দর্শক নাটক দেখতে পারবেন। এখন চলছে নির্মাণকাজ। ধীরে ধীরে এটি হয়ে উঠবে দনিয়া এলাকার মানুষের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখন এখানকার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলে দনিয়া পাঠাগারকে কেন্দ্র করে। এখানে আছে বেশ কয়েকটি নাটকের দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। তাতে বিপুলসংখ্যক দর্শকের সাড়া পেয়েছেন। সেখান থেকেই এই থিয়েটার মঞ্চ তৈরির পরিকল্পনা। দনিয়া পাঠাগার ও দনিয়া সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মো. শাহনেওয়াজ। তিনি ঢাকার মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদকও। মঞ্চটি করার উদ্যোগ নিয়ে বলেন, ‘এই এলাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও বেশ কয়েকটি হাইস্কুল আছে। আমরা এখানে পয়লা বৈশাখের আয়োজন করি। বইমেলার আয়োজন করি। লোকজ উৎসব, বিজয়ের নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবসহ নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন করি। সেখানে দর্শকের উপচে পড়া ভিড় থাকে। একটা উৎসবে আমরা টিকিট কেটে দর্শকদের নাটক দেখানোর ব্যবস্থা করি। অবিশ্বাস্যভাবে অনুষ্ঠানের চার দিন আগেই টিকিট শেষ হয়ে যায়। আমাদের কাছে মনে হলো এবার এখানে একটি নাটকের মঞ্চ করা যায়। যদিও আমরা নাটকের মঞ্চের স্বপ্ন দেখেছি নব্বই দশক থেকেই।’

প্রাথমিকভাবে ছোট ছোট নাটক করা হবে এখানে। একসঙ্গে পরপর দুটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। ঢাকার বড় বড় নাট্যদলকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে নাটক প্রদর্শনীর জন্য। এ ছাড়া আবৃত্তি, গান ও লোকজ পরিবেশনাও করা হবে। এর পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন সপ্তাহে এক দিন। তা স্বল্পদৈর্ঘ্য হতে পারে আবার পূর্ণদৈর্ঘ্যও। শাহনেওয়াজের ভাষায়, এখানে স্কুল ও কলেজ মিলিয়ে বিশাল একটা শিক্ষার্থী সমাজ আছে। তাদের সবাইকে একটা সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক আবহে গড়ে তোলা উচিত। পাঠাগারের সঙ্গে এত দিন তারা সম্পৃক্ত ছিল। এবার এই মঞ্চকে ঘিরে তাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ হবে। এ জন্য নাটকের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ভালো ভালো চলচ্চিত্রও প্রদর্শন করা হবে।

ঢাকার পাশের এই এলাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে প্রায় ৪০টির মতো। দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট নামে একটি সাংস্কৃতিক মোর্চাও আছে। সুরসাগর ললিতকলা একাডেমির সভাপতি ও দনিয়া কচিকাঁচার মেলার পরিচালক এম এ আজাদ বলেন, ‘ছোট অনুষ্ঠানের জন্য এই মঞ্চটি আদর্শ হবে বলে মনে করছি। মঞ্চের সংকট সবখানে। সেই সংকটের মধ্যে ছোট হলেও এটি কম পাওয়া নয়। এই চিন্তা করেই মঞ্চটি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

একসময় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো স্কুল-কলেজে অনুষ্ঠান করত। কিন্তু এখন স্কুল-কলেজগুলো বিভিন্ন দিবসে নিজেরাই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ফলে একটি নির্দিষ্ট মঞ্চ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এখানে ওরকম মাঠও নেই যে, সেখানে আয়োজন করা যায়। বলে মনে করেন এম এন আজাদ।

দনিয়া সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাফিজ বলেন, ‘এটা আমাদের দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন ছিল। যে স্বপ্ন সবার প্রচেষ্টায় বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। এই এলাকায় অনেক স্কুল-কলেজ আছে। এখানে প্রচুর শিশু আছে, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা যদি লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে তাদের যে মননশীলতা, তার উৎকর্ষ সাধন হবে। দেশের সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে। এই সুনাগরিক হতে পাঠাগার ও স্টুডিও থিয়েটারটি বড় ভূমিকা পালন করবে।’

এই এলাকায় চন্দ্রকলা নাটকের দল চালান এইচ আর অনিক। তিনি দনিয়া পাঠাগারের সাংগঠনিক সম্পাদকও। তিনি বলেন, ‘এখান থেকে ঢাকার শিল্পকলায় গিয়ে নাটক করা কষ্টকর। এখানকার দর্শকদেরও অত দূর গিয়ে নাটক দেখে আসাটা কঠিন। নিজেরাই নিজেদের মঞ্চ করার উদ্যোগ নিয়েছি।’

মঞ্চটি করতে সাহস জুগিয়েছেন ঢাকার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও। মো. শাহনেওয়াজ জানালেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান আরিফের সহযোগিতার কথা। সংস্কৃতিজনদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা প্রশংসাও করেছেন এই উদ্যোগের। সরকারিভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসারও কথা বললেন কেউ কেউ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘দনিয়া একটা ঘনবসতিপূর্ণ পশ্চাৎপদ এলাকা। সেখানে বিনোদন ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার তেমন কোনো সুযোগ নেই। দনিয়া পাঠাগার ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে এটি তৈরি হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখবে। আমি মনে করি, সরকারের উচিত হবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।’

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহাসচিব কামাল বায়েজীদ বলেন, ‘দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট একেবারেই তরুণেরা করেছে। অন্যান্য এলাকায় এভাবে জোটবদ্ধভাবে কাজ করতে দেখা যায় না। তাই এটা প্রশংসার দাবি রাখে। আমি প্রশংসা করি যে তারা নিজেদের টাকায় একটা স্টুডিও থিয়েটার করছে। ঢাকায় কিন্তু ওইভাবে স্টুডিও থিয়েটার হয়নি। সে ক্ষেত্রে দনিয়ার স্টুডিও থিয়েটার একটা মাইলফলক হবে বলে মনে করি।’

সবকিছু মিলে দনিয়ার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এই স্টুডিও থিয়েটার ও পাঠাগারটি। এমনটি ধারণা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের। ৫ আগস্ট দনিয়া পাঠাগারে বসে যখন সেখানকার নাট্যজনদের সঙ্গে কথা হয়, তখন তাঁদের চোখে ছিল আরও বড় ধরনের স্বপ্ন। দনিয়া পাঠাগারের সভাপতি মো. শাহনেওয়াজ বলছিলেন, ভবিষ্যতে এখানে একটি শিল্পকলা একাডেমির স্বপ্ন দেখেন তাঁরা। তার বীজ হয়তো বোনো হলো এই স্টুডিও থিয়েটার দিয়ে।