চলচ্চিত্রের প্রদীপ হাতে এক তরুণ

মেহেদী হাসান
মেহেদী হাসান

ছোটবেলা থেকেই চেয়েছিলেন কবিতা লিখবেন। সাহিত্যের প্রতি ঝোঁকটা বেশ। আঁকাআঁকিতে আগ্রহ। সেই আগ্রহ থেকে চারুকলায় ভর্তি হতে চেয়েছিলেন মেহেদী হাসান। কিন্তু ভাগ্য নিয়ে গেল অন্যদিকে। ভর্তি হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। তখন লেখালেখিতে দারুণ আগ্রহ। তাতে হঠাৎ ভাঙন ধরিয়ে দেয় নতুন এক মাধ্যম। চলচ্চিত্র। আগে তো দু-একটা দেখেছেন! কিন্তু একটি সিনেমা যেন সব চিন্তা ওলটপালট করে দেয়। আলাদা কিছুর খোঁজ পান তিনি। সেই থেকে আঁকাআঁকি, লেখালেখি—সবকিছু উধাও। চলচ্চিত্রই ধ্যান-জ্ঞান।

মেহেদী হাসান কে? এই প্রশ্ন যাঁদের মাথায় আসতে পারে তাঁদের বলি, এবারের লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে ওপেন ডোরস হাব থেকে মেহেদী হাসানের চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি সিএনসি পুরস্কার পেয়েছে। সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসব বিশ্বের নামকরা উৎসবগুলোর একটি। সেখানে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রকারদের হারিয়ে বাংলা সিনেমা জিতে নিয়েছে এই পুরস্কার। তাই মেহেদী হাসানকে চেনা দরকার। জহির রায়হান, আলমগীর কবির, তারেক মাসুদদের উত্তরসূরি যে তাঁর মতো তরুণেরাই।

লোকার্নো থেকে গেছেন ভারতেও। তারপর এসেছেন দেশে। সব মিলিয়ে ৪৫ ঘণ্টার যাত্রার ক্লান্তির ছাপ তখনো যায়নি। ১২ আগস্ট কল্যাণপুরে নিজের বাসায় মেহেদীর মুখোমুখি। ঘরজুড়ে আমাদের সঙ্গী মাত্র একটি বিড়াল। সঙ্গী না পেয়ে আমাদের চলচ্চিত্র আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে ও। আপাতত গড়াগড়ি করা ওর কাজ। আমরা কথা চালাই।

জানতে চাই চলচ্চিত্র উৎসবের অভিজ্ঞতা নিয়ে। মেহেদী বলেন, ‘ওটা আসলে একটা বিশেষ আয়োজন। তিন বছরের এই আয়োজন “ওপেন ডোরস” নামে পরিচিত। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশ বিশেষ বিবেচনায় থাকে উৎসবের এই আয়োজনে। যেসব দেশের পরিচালকেরা স্বাধীন সিনেমা করতে চায়, ভালো সিনেমা করতে চায়, তাদের ওরা তুলে ধরে।’

মেহেদীর কথায় উঠে আসে, ২০১৬ সালে প্রথমবার তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আই অ্যাম টাইম ওপেন ডোরসে প্রদর্শিত হয়। ২০১৮ সালে শেষ বছর প্রদর্শিত হয় ডেথ অব আ রিডার। এ বছরই সিএনসি পুরস্কার জেতে তাঁর চলচ্চিত্র প্রকল্প ‘স্যান্ড সিটি’। এই পুরস্কারের আওতায় ছবিটি বানাতে তিনি পাচ্ছেন আট হাজার ইউরো। সঙ্গে থাকছে সুইজারল্যান্ডে দুই মাস থাকার সুযোগ। মেহেদী জানান, পাণ্ডুলিপি ঘষামাজা করতেই এই দুই মাস ব্যয় করবেন। বলে রাখি, লোকার্নোর ওপেন ডোরস আয়োজনে পুরস্কার জিতেছিলেন তাঁরই অগ্রজ কামার আহমাদ সাইমন ও রুবাইয়াত হোসেন।

কথায় কথায় সময় গড়ায়। তেষ্টা পায় দুজনেরই। আমরা চা পানের প্রস্তুতি নিই। চুলায় পানি গরম হয়। পাশাপাশি রান্নাঘরেও চলে আমাদের কথাবার্তা। উঠে আসে বিশ্বের চলচ্চিত্র জগতের নানা পরিচালকের নাম। চলে আসে রাশিয়ার আন্দ্রেই তারকোভস্কি, হাঙ্গেরির বেলা তর, তুরস্কের সেমিহ কাপলানোগলু, ভারতের সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, পোল্যান্ডের কিওসলোস্কি, সুইডেনের বার্গম্যানসহ নানা চলচ্চিত্রকার ও তাঁদের কাজ। কথা হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নানা সমস্যা নিয়ে।

কথা ঘুরিয়ে দিই। তাঁর চলচ্চিত্রের কাজের দিকে মনোযোগ ফেরাই। জানতে চাই চলচ্চিত্র নিয়ে শুরুর দিকের কথা। মেহেদী বলেন, ‘আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ভর্তি হয়েছি। আমার সাহিত্য আর পেইন্টিং ভালো লাগত। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে একটা সিনেমা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই। আরে, এটা তো অন্য রকম। মূলধারার সিনেমা ছাড়া তো আমার কাছে কখনোই এই সিনেমা পৌঁছায়নি। আমি ওই সিনেমাটা বারবার দেখতাম। তারপর হলে বসে বন্ধুরা একসঙ্গে দেখতাম বিশ্বের নানান পরিচালকের ছবি। ভাবতাম, কিছু করা যায় কি না।’

সেই ভাবনা থেকে মেহেদী কয়েকটি কোর্সও করে ফেলেন। অংশগ্রহণ করেন কিছু প্রতিযোগিতায়ও। ওসব কোর্স ও কর্মশালার শিক্ষা বেশ কাজে দেয় সিনেমা তৈরিতে। কর্মশালার হয়ে কিছু ছবিও বানান। কিন্তু ও কাজগুলো মনে ধরে না। একদিন নিজের কাছে থাকা একটি ক্যামেরা ও সাউন্ড ডিভাইস নিয়ে শুরু করেন প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাজ। প্রথম সিনেমার অভিনয়শিল্পী হলেন নিজের ‘মা’। ছবির নাম ফটোগ্রাফস অব আ স্কুল টিচার। সালটা ২০১২। সাহসের শুরুটা এখানে। এরপর শুধুই পথচলা। সিনেমার অভিনয়শিল্পীরা কাছের বন্ধুজন। একে একে করে ফেলেন আই অ্যাম টাইম, হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম, ডেথ অব আ রিডার। আর প্রথমবারের মতো পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিতে হাত দিলেন ‘স্যান্ড সিটি’র মাধ্যমে।

কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। উঠতে হয়। বিদায় নিয়ে চলে আসি। তবে একটা কথা না বললেই নয়। তরুণ এই চলচ্চিত্রকারের চোখে যে আশার আলো দেখি, তাতে বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন আসবে, এ সত্যি। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রদীপ যে এই তরুণদের হাতেই।