নে, এইবার চুমা দে!

স্বামী কার্লো পন্টির সঙ্গে সোফিয়া লরেন
স্বামী কার্লো পন্টির সঙ্গে সোফিয়া লরেন

প্রকৃত শিল্পীর মধ্যেই থাকে শিল্পসত্তা। এটা জন্মগত। চর্চা করে কেউ দৃশ্যমান শিল্পী হলেও প্রকৃত শিল্পীরই থাকে জন্মগত প্রতিভা। খেলা দিয়ে বলি। ব্যাট চালালেই ক্রিকেটার হয় না, ফুটবলে লাথি দিলেই নেইমার হয় না। আমাদের পেসার মোস্তাফিজ গ্রাম থেকে মাইলকে মাইল দূরের মাঠে এসে প্র্যাকটিস করেছেন। সেই মাঠে অনেক শিশু তাঁর সঙ্গে খেলেছে। তারা তো মোস্তাফিজ হয়নি।

যেকোনো শিল্পীরই থাকতে হবে সূক্ষ্ম রসবোধ। সেন্স অব হিউমার। এটা শিল্পসত্তার প্রধান উপাদান। সেন্স অব হিউমার এক গুণ, যা ফুটিয়ে তোলে শিল্পীর শিক্ষা ও আবেদনময়ী দর্শন। ভাঁড়ামি না, হিউমার। মাইন্ড ইট।

হিউমার সেন্স এত দামি কেন? কারণ আছে। আপনি আপনার আর সব সেন্স মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন। শুধু হিউমার সেন্স শেয়ার করতে আপনার মানুষ লাগবে। তাই হিউমার সেন্স সবচেয়ে ক্ল্যাসিক। এই সেন্স সঠিক অর্থে থাকতে হবে একজন সেলিব্রিটির। কারণ, সেলিব্রিটিও ক্ল্যাসিক মানুষ। সাধারণ মানুষ তা-ই ভাবে।

সেলিব্রিটিদের নানা মজার কথা বা গল্প-কাহিনিতে মজা পায় মানুষ। তীক্ষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি, স্মার্টনেস আর উদ্ভট কারবার ঘটান সেলিব্রিটিরা। উল্টাপাল্টা বলেই তাঁরা জিনিয়াস। হয়েছেন সেলিব্রিটি।

‘ক্লিওপেট্রা’ ছবিতে এলিজাবেথ টেইলর
‘ক্লিওপেট্রা’ ছবিতে এলিজাবেথ টেইলর

হলিউডের হার্ট থ্রব সোফিয়া লরেনের স্বামী কার্লো পন্টি দেখতে ভালো ছিলেন না। সোফিয়া লরেনের চেয়ে পাক্কা ১ ফুট ছোট। ভোটকু। অথচ সোফিয়া তাঁকে ভীষণ ভালোবাসেন। সেটা অসহ্য লাগে সোফিয়ার প্রেমপ্রার্থী হ্যান্ডসাম অভিনেতাদের। তাঁরা টিজ করে কার্লো পন্টিকে অক্সিজেন সিলিন্ডার বলে ডাকেন। মেকআপ রুম থেকে সোফিয়া হঠাৎ অনবরত ‘পন্টি, পন্টি’ চিৎকার করে উঠলেন। ‘হোয়াটস রং!’ জিজ্ঞেস করতেই সোফিয়ার সোজা উত্তর, ‘পন্টি আমার অক্সিজেন সিলিন্ডার। পাশে না থাকলে অক্সিজেন কমে যায়। হাঁসফাঁস লাগে।’

এই যে উপস্থিত উত্তরের সৌন্দর্য, এর সঙ্গে কি সোফিয়ার বাহ্যিক সৌন্দর্যের কোনো সম্পর্ক আছে? অবশ্যই আছে। এই দুই সৌন্দর্য মিলেছে বলেই তো তিনি সেলিব্রিটি।

সেলিব্রিটিদের ছোট ছোট অনেক মজার কাজ ফ্যানদের আনন্দ দিয়েছে। তাঁদের চিন্তার সঙ্গেও ফ্যানরা পরিচিত হয়েছেন তাঁদের ইন্টারভিউ দেখে বা পড়ে। কিংবদন্তি অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেইলরকে যখন বলা হলো, ‘তুমি তো সবই পেয়ে গেছ জীবনে।’ ত্বরিত উত্তর দিলেন এলিজাবেথ, ‘সরি, এখনো আগামীকালটা পাইনি।’ এর চেয়ে তীক্ষ্ণ উত্তর আর কী হতে পারে? এলিজাবেথকে একটু জেলাস করার জন্য বলা হলো, ‘ক্লিওপেট্রাকে আপনি কীভাবে দেখেছেন?’ চট করে লিজ টেইলর বললেন, ‘আসলে তাঁর পাশে এত সব ঘটনা ঘটছিল, আমি ঘটনা দেখেছি, তাঁকে দেখি-ইনি!’

মে ওয়েস্ট
মে ওয়েস্ট

পশ্চিমের সেলিব্রিটিদের মধ্যে হিউমার সেন্স বা তাৎক্ষণিক বুদ্ধিদীপ্ততা লক্ষণীয়ভাবেই বেশি দেখা গেছে। এর কারণ বা উত্তর আসলে এখনো অজানা। সামগ্রিক মিডিয়ার উচ্চমান দক্ষ মিডিয়াকর্মী বানাতে পারে, কিন্তু প্রতিভা? সেটা কি প্রতিষ্ঠান বানাতে পারে? লক্ষ করলে দেখা যাবে, পশ্চিমা বিনোদন জগতে সাংবাদিক বা টিভি উপস্থাপকদের প্রতিভা তাঁদের বিশ্বখ্যাত সেলিব্রিটি বানিয়েছে। আমেরিকার ‘ল্যারি কিং লাইভ’-এর ল্যারি কিংবা এইচবিও চ্যানেলের ‘রিয়েল টাইম’-এর বিল মাহের বিশ্বকাঁপানো টিভি উপস্থাপক। আর এই মাপের অসংখ্য সাংবাদিকের সঙ্গে হিউমারের টক্কর দিতে গেলে বিনোদন সেলিব্রিটিদেরও লাগবে ধারালো মেধা। হলিউডের আবেদনময়ী গায়িকা-অভিনেত্রী মে ওয়েস্টকে বোল্ড করার জন্য সুচতুর সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কতজন পুরুষের কোলে বসেছেন?’ চট করে মে ওয়েস্ট বললেন, ‘ডাইনিং টেবিল ন্যাপকিন আপনার কোলে যতবার বসেছে, তার চেয়ে বেশি!’ টেবিল এটিকেটের একটি হলো, খাওয়ার আগে টেবিল ন্যাপকিন কোলে বিছানো।

পশ্চিমা সেলিব্রিটিদের সুবিধা আছে। তাঁরা খোলামেলা কথা বলে ফেলতে পারেন। শুধু খোলামেলা কথা কেন? তাঁদের জ্ঞানগর্ভ দার্শনিক কথা কি শিক্ষণীয় হয়নি? সুপারস্টার পল নিউম্যানের বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘যাঁর কোনো শত্রু নেই, তাঁর কোনো চরিত্রও নেই!’ যেন দর্শনের কোনো প্রফেসর কথাটা বলেছেন।

এলভিস প্রিসলি
এলভিস প্রিসলি

লেডি কিলার গায়ক এলভিস প্রিসলির এই ঘটনা তো কিংবদন্তি। তাঁর সাদা রঙের রোলস রয়েস গাড়িটা বাইরে রেখে শো করতে ঢোকেন। শো শেষে বেরিয়ে এসে দেখেন, দুষ্টু মেয়েরা ঠোঁটের লিপস্টিকে পুরো লাল করে থুয়ে গেছে গাড়ি। ওয়াশ করান। আরেক শো থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন গাড়ি আবারও লিপস্টিকে লাল। আর কাঁহাতক? গাড়ির রংই পাল্টে লাল করে ফেলেন। নে, এইবার চুমা দে!

গ্রেগরি পেক লেডি কিলিং টাইপ গুরুগম্ভীর থাকলেও হিউমার সেন্স ছিল প্রখর। পড়াশোনা ছেড়ে অভিনয়ে আসেন। স্কুল তাঁর কী উন্নতি করেছে? এর জবাবে বলেন, ‘স্কুল আমাকে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি থেকে ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা করেছে।’ হিউমারের পাশে তাঁর গভীর দর্শনও ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। বলেছেন, ‘কঠিন সময় থাকে না, কঠিন মানুষই থাকে!’

অভিনেত্রী জিনা লোলো ব্রিজিদার চল্লিশে মেয়েদের সম্পর্কে মন্তব্য ছিল, ‘মেয়েরা ২০-এ বরফ থাকে, ৩০-এ উষ্ণ হয় আর ৪০-এ ফুটতে শুরু করে!’

মোৎসার্ট
মোৎসার্ট

সেলিব্রিটিরা অভিনয়ের পাশাপাশি সব সময় বুদ্ধিদীপ্ততার স্বাক্ষর রেখেছেন। আবার অভিনয়ের সময় তাঁরা ক্রিয়েটিভিটি ছাড়া কোনো দিকে নজর দেননি। আবার গ্রেগরি পেকের কথায় আসতে হয়। অভিনয় সম্পর্কে বললেন, ‘আমি এখানে কোনো প্রফেসরের মতো লেকচার দিতে আসিনি, শ্রমিকের মতো কুড়ালে ধারও দিতে আসিনি। এসেছি বিনোদন দিতে। এর মধ্যেই দর্শক শুনবে প্রফেসরের লেকচার, দেখবে শ্রমিকের কাঠ কাটা!’

সেলিব্রিটিরা জিনিয়াস। সুরের লিজেন্ড মোৎসার্টকে তখন হিংসা করে তাবৎ মিউজিক কম্পোজার। এক লাইভ অনুষ্ঠানে মোৎসার্টের হাতে হিংসুটে কম্পোজাররা ধরিয়ে দেন এমন স্বরলিপি, যা বাজাতে ১০ আঙুলে হবে না, ১১টা আঙুল লাগবে। চ্যালেঞ্জ নিলেন মোৎসার্ট। বাজাতে বাজাতে যখন ১১তম আঙুল দরকার, নাক দিয়ে তা বাজাতে লাগলেন। তালিতে ফেটে পড়ল হল!

চার্লস ব্রনসন
চার্লস ব্রনসন

রাফ অ্যান্ড টাফ ওয়েস্টার্ন অভিনেতা চার্লস ব্রনসনের ফেস ছিল রুক্ষ, ফাটা ফাটা। ফেস রুক্ষ কেন? এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এই ফেসের ভেতরে হীরার খনি আছে, তাই ডিনামাইট মেরে ফাটানো হয়েছে!’

প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম, বিশ্বের বেশির ভাগ সেলিব্রিটি বা জিনিয়াস জীবনে সুখী ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের ক্রিয়েটিভ দর্শন আর সেন্স অব হিউমার জীবনকে করেছে মহিমান্বিত। ফ্যানদের দিয়েছে আনন্দ আর চিন্তার খোরাক।

কমেডির রাজা চার্লি চ্যাপলিন যতটা না ছিলেন কমেডিয়ান, তার চেয়ে বেশি দার্শনিক। তবে তাঁর অণু-পরমাণুতেই তো ছিল হিউমার সেন্স। একবার বিজ্ঞানের রাজা আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে দেখা হলে আইনস্টাইন চার্লিকে বলেন, ‘আচ্ছা, আমি হচ্ছি পদার্থবিদ, তুমি হচ্ছ অভিনেতা। মানুষ আমাদের দুজনকে দেখেই তালি দেয় কেন?’ চার্লি চ্যাপলিন চট করে বলেন, ‘মানুষ আমাকে বুঝে তালি দেয়, আর তোমাকে তালি দেয় কিছু না বুঝে।’ খুব কষ্টে বড় হওয়া চার্লি চ্যাপলিনের হিউমার সেন্সের সঙ্গে দর্শনের কথাগুলো অমূল্য। বলেছেন, ‘আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু আমার আয়না। আমি যখন কাঁদি, একমাত্র সে-ই হাসে না!’ বড় কমেডিয়ানের বড় কষ্ট।

চার্লি চ্যাপলিন
চার্লি চ্যাপলিন

এই গ্রহে এখন পর্যন্ত পশ্চিমা সেলিব্রিটি অভিনেত্রীদের মধ্যে সেরা সুন্দরী কে? নিরঙ্কুশ ভোট পাবেন মেরিলিন মনরো। শুধু সুন্দরী না, বান্দরীও ছিলেন। মুখে আটকাতো না কিছু। কোটি কোটি ফ্যান ছিল তাঁর। কিন্তু জীবন সুখের ছিল? জন্ম থেকেই মা ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। নিজে স্ক্যান্ডালে হয়েছিলেন জর্জরিত। মৃত্যুও রহস্যে ঘেরা। সদা উচ্ছল, লাস্যময়ী হৃদয়কাড়া এই অভিনেত্রীর সেন্স অব হিউমার ছিল কিংবদন্তি। কিন্তু জ্ঞানগর্ভে ভরা। বলছেন, ‘ভদ্রসদ্র মেয়েরা কখনো ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে না।’ আবার কখনো বলেছেন, ‘জীবন কেমন, তা তুমি কখনোই বুঝবে না, যতক্ষণ না তা যাপন করছ।’ তাঁর কথাগুলো ছিল সেন্সরবিহীন, মজার। বলতেন, ‘বোরিং হওয়ার চাইতে উল্টাপাল্টা হওয়া ভালো।’ বলেছেন, ‘অভিনেত্রী হওয়ার চেয়ে অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখা বেশি মজার।’ মেয়েদের বিষয়ে তাঁর দর্শন ছিল গভীর। বলেছিলেন, ‘একটা মেয়েকে তার সঠিক জুতাটা পরিয়ে দাও, সে বিশ্ব জয় করে এনে দেবে।’

আমাদের কবিতায় আছে, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশির বিন্দু!’ চলেন দেখি।

মেরিলিন মনরো
মেরিলিন মনরো

বহু আগে সাদাকালো যুগে আমাদের সিনেমা জগতে এক কিংবদন্তি কমেডিয়ান ছিলেন, খান জয়নুল। খুব জনপ্রিয়। ক্ল্যাসিক অভিনেতা। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে সচ্ছল ছিলেন না। ঘটনাটি এক সিনিয়রের কাছ থেকে শোনা। খান জয়নুলের কাছে টাকা নেই। পাওনা হয়েছে প্রডিউসারের কাছে। খালি মানিব্যাগে টাকার জায়গায় তিনি পান ভরছেন টাকার মতো কেটে কেটে। খুচরা পয়সার জায়গায় রাখছেন কুচি কুচি সুপারি। ফটো রাখার পলিথিন চেম্বারে রাখছেন চুন। প্রডিউসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছ!’ খান জয়নুল বললেন, ‘আইজকা আপনের মানিব্যাগ আমাগো লাঞ্চ খাওয়াইব আর আমার মানিব্যাগ লাঞ্চের পর আপনাগো খাওয়াইব পান!’

কথাটির সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি। তবে, যাহা রটে, তাহা কিছু তো বটে!